ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীতে খাদ্যবান্ধব চাল যাচ্ছে প্রভাবশালীদের ঘরে

থামছে না চালবাজি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২১ অক্টোবর ২০১৬

থামছে না চালবাজি

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ রাজশাহীতে ১০ টাকা দরের চাল নিয়ে ‘চালবাজি’ থামছে না। হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হলেও চাল বাগিয়ে নিচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। চাল পাওয়ায় যোগ্য জেলার দরিদ্র আদিবাসীরাও পাননি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর এক ছটাকও চাল। জেলার পবা উপজেলার হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের হতদরিদ্র আদিবাসীরা চালের জন্য আবেদন করে উল্টো বিপাকে পাড়েছেন। তাদের হুমকি-ধামকি দেয়া হচ্ছে। স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও সচ্ছল পরিবারকেও তালিকাভুক্ত করায় ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী। জেলার প্রায় উপজেলার চিত্র একই। জানা গেছে, পবা উপজেলার হুজুরীপাড়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১২৫ আদিবাসী পরিবারের কেউ পায়নি চাল। তবে এই ওয়ার্ডে ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক, শিক্ষকের স্ত্রী এবং একই পরিবারের দুই থেকে চারজন কার্ড পেয়েছেন। অথচ দরিদ্র আদিবাসী পঙ্গু ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়েছেন। নওহাটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকের স্ত্রী লাইলা ইয়াসমিন ইতোমধ্যে কার্ড বাগিয়ে নিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোজাহার আলী বলেন, তালিকা করেছেন স্থানীয়রা নেতারা। তালিকা তৈরির পাশাপাশি চাল বিতরণেও ‘নয় ছয়’ কারবার চলছে রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায়। ওজনে কম দেয়া, কার্ডপ্রাপ্ত সুবিধাভোগীদের মাঝে কার্ড বিতরণ না করে নিজের কাছে রেখে দেয়া, একদিনের চাল বিক্রি করে দুই দিনের চাল বিক্রির রেজিস্ট্রারে সই করে নেয়া, হতদরিদ্রদের নামের তালিকা না করে সচ্ছল পরিবারের নামের তালিকাসহ নানান অভিযোগ তো রয়েছেই। কর্মসূচী বাস্তবায়নে গোদাগাড়ীতেও চলছে এসব নানান চালবাজি। জেলার ৭২ ইউনিয়নই এই চাল বিতরণ অনিয়মে ভরা। উপজেলার ৯ ইউনিয়নে চাল বিক্রির নিয়োগ ডিলার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে চলছে এসব কারবার। বেশিরভাগ ডিলার সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা। উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের পানিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মনিরুল ইসলামের ছেলে কার্ড প্রাপ্ত শরিফ অভিযোগ করেন গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর সাহেবনগর মোড়ে ডিলাররা ১১ টাকায় চাল বিক্রি করেছেন। উপজেলার বাসুদেবপুর ইউনিয়নে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলার ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগ নেতা কুতুবুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাল বিক্রির সময় ওজনে কম দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাটিকাটা ইউনিয়নের ডিলার হারুন অর রশিদ ও আরিফুল ইসলাম চাল বিক্রিতে সঠিক নিয়ম মানছেন না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। এছাড়াও এই ইউনিয়নে হতদরিদ্রের তালিকা না করে উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের ইন্ধনে সচ্ছল ও বিত্তবানদের তালিকা করে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ নেওয়াজ বলেন, কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তিনি। এদিকে জেলার মোহনপুর উপজেলায় ৫০ বিঘা সম্পত্তির মালিকের ছেলের নামে হতদরিদ্রের কার্ড জুটেছে। অথচ কার্ড পাননি বিধবার ছেলে ভ্যানচালক কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। মোহনপুরে ১০ টাকা মূল্যের চালপ্রাপ্ত উপকারভোগীদের তালিকায় স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ ও সচ্ছল পরিবারকেও অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়েছে। উপজেলার বাকশিমইল ইউনিয়নের ভেটুপাড়া গ্রামের ৫০ বিঘা জমির মালিক হোসেন মৃধার ছেলে কার্ড পেয়েছেন। কিন্তু কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত আব্দুলের বিধবা স্ত্রী নিলুফা এই কার্ডের আওতায় আসেননি। একই গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম পেয়েছেন এই কার্ড। শুধু তিনিই নেননি। এই নেতা তার দুইভাইকেও কার্ড পাইয়ে দিয়েছেন। জানা গেছে, জেলার সব উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নের চিত্র কমবেশি একই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক জনপ্রতিনিধি বলেন, অনেকটা তড়িঘড়ি করে তালিকা করাই কিছুটা গরমিল হয়েছে। আগামী পর্বে দেখেশুনে তালিকা তৈরি করা হবে। যশোরে ব্যবসায়ী ও বিত্তবানদের নামে কার্ড স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, মণিরামপুর উপজেলার কতিপয় ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বরদের ব্যাপক অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতিতে প্রশ্নবিদ্ধ করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে হতদরিদ্রদের জায়গায় স্থান পেয়েছে বিত্তবানরা। এমনকি ইউপি সদস্য ও তার স্ত্রী তালিকায় নাম রয়েছে। অপরদিকে চাল বিতরণে ওজনে কম দেয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে ডিলারদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে এসব অভিযোগে ডিলারশিপ বাতিলসহ জরিমানাও করা হয়েছে। জানা যায়, হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের বিশেষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী আওতায় এ উপজেলায় ২৩ হাজার ৪১৯ জনকে ১০ টাকার চালের জন্য তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই সমাজের বিত্তবান সারির মানুষ। আবার হতদরিদ্র এমনকি ভিক্ষুকও তালিকায় ঠাঁই হয়নি। কার্ড প্রাপ্তদের মধ্যে অনেকের আছে পাকা বাড়ি ও মাছের ঘেরসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, সদর ইউনিয়নের মেম্বর আনোয়ার মোল্যা ও তার স্ত্রী তাসলিমা, মেম্বরের ভাই আড়ত ব্যবসায়ী আহাদ মোল্যা ও তার ছেলে রাসেল, ভাই আজগর মোল্যা, ভাইজি ময়না খাতুন ১০ টাকা চালের কার্ড বাগিয়ে নিয়েছেন। আনোয়ার মোল্যা তা স্বীকারও করেছেন। উপজেলার পদ্মনাথপুর গ্রামের আবু বক্কার সরদারের ছেলে শহিদুল সরদার, মিকাইলের ছেলে আতর আলী, আব্দুল মজিদ সরদারের ছেলে আশরাফ আলী সরদার, আফসার আলী সরদারের ছেলে শুকুর আলী, রাজআলী, উপজেলার ঢাকুরিয়া ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য মকবুল হোসেনের ছেলে ইনামুল, লাল বিশ্বাস, মৃত হাকিমের ছেলে আমান উল্লাহ, মকছেদের ছেলে ওলিয়ার, তকবার মোড়লের ছেলে নজরুল ইসলামসহ অধিকাংশ কার্ডধারীর পাকা বাড়ি, আছে মাছের ঘের ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব বিষয় জানতে চাইলে উপজেলা ফেয়ার প্রাইজ কার্যক্রম কমিটির সভাপতি ও নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, অনিয়ম হলে রক্ষা নেই। জেল জরিমানাসহ ডিলারশিপ বাতিল করা হবে। এ বিষয়ে সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, হতদরিদ্রদের জন্য সরকারের বিশেষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচীতে কোন অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না। যে অনিয়ম করার চেষ্টা করবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবেই। ঠাকুরগাঁওয়ে কার্ড ফেরত চেয়ে মাইকিং নিজস্ব সংবাদদাতা ঠাকুরগাঁও থেকে জানান, সদর উপজেলার বিত্তবানদের ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড ফেরত দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে বৃহস্পতিবার মাইকযোগে এ আহ্বান জানানো হয়। সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ১০ টাকা কেজি দরে চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ চাল বিতরণের জন্য তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের কার্ড দেয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় খাদ্য অধিদফতর এ তালিকা করে। কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ে তালিকা তৈরি ও কার্ড বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে ১৯ অক্টোবর ‘ঠাকুরগাঁওয়ে খাদ্যবান্ধব চাল বিতরণ-ব্যবসায়ীদের নামে কার্ড’ শিরোনামে জনকণ্ঠে সংবাদ প্রকাশিত হয়। নানা অভিযোগ পেয়ে কর্মসূচীতে স্বচ্ছতা আনতে বৃহস্পতিবার সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যানদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করে উপজেলা প্রশাসন। সভায় উপজেলা তালিকা যাচাই কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর কার্ড বিতরণে অনিয়মের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) পদক্ষেপ নিতে বলেন। এরপর তালিকা সংশোধনের জন্য বিত্তবান ও কার্ড পাওয়ার অযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে কার্ড ফেরত চেয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকযোগে প্রচার চালানো হয়।
×