ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃত্রিম সঙ্কটের মুখে চালের বাজার

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৬

কৃত্রিম সঙ্কটের মুখে চালের বাজার

এম শাহজাহান ॥ কৃত্রিম সঙ্কটের মুখে চালের বাজার। পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও ‘সঙ্কট’ সৃষ্টি করে চালের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। এজন্য চালের মিলমালিক, মোকাম ও আড়তদার, পাইকারি এবং সবশেষে খুচরা ব্যবসায়ীরাও দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দু’মাসের ব্যবধানে কেজিতে মোটা চালের দাম বেড়েছে ১০-১২ টাকা। সরু ও চিকন চালে প্রতিকেজিতে ৬-৮ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে। বাজার সামাল দিতে শীঘ্রই খোলা বাজারে ১৫ টাকা কেজি চাল বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এদিকে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় সারাদেশে হতদরিদ্রদের ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই কর্মসূচীর বাস্তবায়ন ও স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গ্রামে চালের সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বস্তি দিয়েছে সাধারণ ভোক্তাদের। এই কর্মসূচীতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা গেলে প্রকৃত হতদরিদ্ররাই স্বল্পমূল্যে চাল কেনার সুযোগ পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাই শহরে মোটা চালের দাম বাড়লেও গ্রামে মূল্যবৃদ্ধির তেমন খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া আগামী মাসের মধ্যে নতুন আমন ধান কাটা শুরু হবে গ্রামে-গ্রামে। সেই ধানের চাল আসবে বাজারে। কৃষকের ঘরে নবান্ন উৎসব শুরু হবে। তাই চাল নিয়ে ব্যবসায়ীদের ‘চালবাজি’ করার সুযোগ আর থাকছে না। তবে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখার স্বার্থে নিয়মিত চালের মিলমালিকদের মোকাম এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের আড়তগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো উচিত বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। এদিকে রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকায় উঠেছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি হারে বেড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের প্রয়োজনীয় মোটা চালের দাম। এক মাস আগে গুটি ও স্বর্ণা জাতের মোটা চাল কেজিপ্রতি ২৮ থেকে ৩০ টাকায় মিলত, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়। সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, এক মাস আগেও মোটা চাল স্বর্ণা ও চায়না ইরির দাম ছিল ৩৩-৩৬ টাকা। এখন এই চাল পেতে ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা। মাসিক মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। মোটা চালের দাম বাড়ায় নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে। মোটা চালের পাশাপাশি বেড়েছে মাঝারি ও সরু চালের দাম। মাঝারি মানের বিআর-২৮ চালের দাম কেজিতে ৫-৬ টাকা ও সরু মিনিকেট চালের দাম ৬-৮ টাকা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। বর্তমানে বাজারে মাঝারি মানের চাল ৪২ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সরু মিনিকেট সাধারণ মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা দরে। তবে উত্তম মানের নাজির ও মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫৬ টাকা। উত্তম মানের পাইজাম ও লতা বিক্রি হচ্ছে ৪২-৪৫ টাকা এবং সাধারণ মানের এই চাল বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকায়। মূল্যবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজধানীর পাইকারি বাজারখ্যাত বাবু বাজারের মেসার্স নিউ মা ভা-ারের চালের ও গমের আড়ত মালিক জিল্লুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েক কারণে ইতোপূর্বে চালের দাম বেড়ে গেলেও এখন বাজার স্থিতিশীল। প্রতিবস্তায় ৩০-৪০ টাকা দাম কমে গেছে। ফলে শীঘ্রই খুচরা বাজারে দাম কমার সুফল পাবেন সাধারণ ভোক্তারা। তিনি বলেন, হঠাৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যায়। আর এ কারণে দাম বেড়ে গেছে। তবে এখন সরবরাহ পরিস্থিতি ভাল, একই সঙ্গে আগামী এক মাসের মধ্যে নতুন কাটা শুরু হবে। তাই আপাতত চালের দাম আর বাড়বে না। এছাড়া ভারতীয় চালের আমদানি এত দিন দাম কমিয়ে রেখেছিল। এখন শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ায় ভারতীয় চাল আসছে না। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। মাসখানেকের মধ্যে নতুন আমন ধানের চাল বাজারে আসতে শুরু করবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের এ সময়টায় চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। তবে অন্য সময়ের তুলনায় এ বছর মোটা চালের দাম বেড়েছে অনেক বেশি হারে। বাজার তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত সহকারী পরিসংখ্যান কর্মকর্তা দিলরুবা জানান, ১৯৪ ভোগ্যপণ্যের মধ্যে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে চালের দামও রয়েছে। তবে বর্তমান দামে চাল কেনার সক্ষমতা রয়েছে সাধারণ ভোক্তাদের। কারণ তাদের রোজগার বেড়েছে। তবে দীর্ঘমেয়াদে চালের দাম বাড়া ভাল কোন লক্ষণ নয়। এদিকে খাদ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৩ অক্টোবর সরকারের গুদামে চাল ও গম মিলে খাদ্য মজুদ ছিল ১৫ লাখ ৯৩ হাজার টন। এবার সেটা ১০ লাখ ৩১ হাজার টনে নেমে এসেছে। গত বছর এ সময় ১২ লাখ ৬০ হাজার টন চাল ছিল। এখন সেটা সাত লাখ ৩৪ হাজার টন। এজন্য তারা ধান সংগ্রহের নীতিকে দায়ী করেছেন। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৬ সালে বোরো সংগ্রহ মৌসুমে ৬ লাখ টন ধান এবং ছয় লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রতিকেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য ২৩ এবং চালের দাম ৩২ টাকা ঠিক করা হয়। পরবর্তী সময়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় একই দরে আরও আড়াই লাখ টন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সাড়ে আট লাখ টন চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়। এ পর্যন্ত ছয় লাখ ৬৯ হাজার ৫৭৭ টন ধান এবং চার লাখ ৬৫ হাজার ১৭৮ টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে চালের দাম এখনও অসহনীয় পর্যায়ে যায়নি বলে মনে করেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তবে বাজার সহনীয় রাখতে ইতোমধ্যে খোলা বাজারে প্রতিকেজি চাল ১৫ টাকা বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। শীঘ্রই এই চাল বাজারে আসবে। তিনি জানান, প্রতিবছর এ সময় চালের দর একটু বাড়ে। তবে এবার স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত থাকতে পারে। বর্তমানে ভারত থেকে চাল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আছে। চাল সংশ্লিষ্টরা চাচ্ছেন তা তুলে দেয়া হোক। শুল্ক তুলে নিলে ভারত থেকে দেদার চাল আমদানি করে একটি মহল নিজেদের আখের গোছালেও দেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই আমরা শুল্ক প্রত্যাহার না করে খোলাবাজারে চাল বিক্রির কর্মসূচী অব্যাহত রাখব।
×