ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চোখে দেখে দেয়া হয় যানবাহনের ফিটনেস সনদ ;###;৩৩ ভাগ যানের সার্টিফিকেট নেই ;###;একটি যন্ত্র এ মাসে চালু হওয়ার কথা

মেশিন বন্ধ ১৬ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১১ অক্টোবর ২০১৬

মেশিন বন্ধ ১৬ বছর

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার জন্য ১৬ বছর আগে শত কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল ভেহিক্যাল ইনস্পেকশন সেন্টার (ভিআইসি) মেশিন। বসানো হয়েছিল বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) মিরপুরের প্রধান কার্যালয়সহ পাঁচটি অফিসে। ফলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা হতো। যানবাহনের অন্তত ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ নির্ভুল পরীক্ষা সম্ভব হতো এ মেশিনের মাধ্যমে। একপর্যায়ে এর কার্যক্রম বন্ধে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। বিআরটিএ’র সুবিধাভোগী কর্মকর্তার অশুভ তৎপরতায় অল্প দিনের মধ্যেই আধুনিক মেশিনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়! শুরু হয় চোখে দেখে ফিটনেস সনদ দেয়া, যা এখনও চলমান। তবে আগামী ৩০ অক্টোবর মিরপুর অফিসে একটি ভিআইসি মেশিন চালুর কথা জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোর কোথাও চোখে দেখে গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়ার কার্যক্রম নেই। এতে যানবাহনের সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। সড়ক নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকেই যায়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০০ সালে বিআরটিএ মিরপুর কার্যালয়ে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভিআইসি মেশিন কেনা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মেশিন বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর থেকে আবারও চোখের দেখায় গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে। এভাবে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, একে একে পাঁচ অফিসের মেশিন বন্ধ করে দেয়ার পর এনালগ পদ্ধতিতে গাড়ির ফিটনেস সনদ দেয়া চলছে বছরের পর বছর। কারও কোন জবাবদিহিতা নেই। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোন ব্যবস্থাও নেয়া হলো না। অথচ বিশ্বের কোন দেশেই চোখে দেখে ফিটনেস দেয়ার প্রথা নেই। পরিবহন সেক্টরের এ বিশেষজ্ঞ বলেন, পদ্ধতিগত উন্নয়ন না হলে দুর্নীতি ছাড়া উন্নতি হবে না। একটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, বিআরটিএ পরিবহন ফিটনেস শাখা ও ড্রাইভিং শাখা দুটোই হয়রানিমূলক, দুর্নীতিগ্রস্ত। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের শেষ নেই। তাছাড়া ত্রুটিমুক্ত যানবাহন নিশ্চিত হলে সড়ক নিরাপত্তাও বাড়বে। এতে দুর্ঘটনার হার অনেকটাই কমে আসবে। এজন্য ভিআইসি চালুর কোন বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত যানবাহনের চালকের সংখ্যা ১০ লাখ ২২ হাজার ৬১৯। একই সময়ে সারাদেশে তালিকাভুক্ত যানবাহনের সংখ্যা ২৭ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ৩৮ হাজার। কার্গোভ্যান ছয় হাজার ৬০৮। মাইক্রো ৮৯ হাজার ৭৩১। মিনিবাস ২৭ হাজারেও বেশি। কাভার্ডভ্যান ১৯ হাজার, ডেলিভারিভ্যান ২৪ হাজার, প্রায় ১৬ লাখ মোটরসাইকেল রয়েছে সারাদেশে। এছাড়াও এক লাখ ১৮ হাজার ট্রাক, ২৩ লাখ ২৪ হাজারের বেশি অটোরিক্সা, তিন লাখ ২৬ হাজার প্রাইভেটকার ছাড়াও আছে অন্যান্য যানবাহন। এসব যানের ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে চোখে দেখে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মোটরযান পরিদর্শক জানিয়েছেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তাদের এ কাজটি করতে হচ্ছে। প্রভাবশালীদের চাপে অনেক সময় গাড়ি না দেখেও সার্টিফিকেট দিতে হচ্ছে। এছাড়া একদিনে অন্তত শতাধিক গাড়ি দেখতে হয়। ফলে মান নিয়ন্ত্রণ কোনভাবেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এ কারণে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরে লক্কড়-ঝক্কড় যানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান তারা। শুরুর পরই বন্ধ ॥ ১৯৯৯ সালে ভেহিক্যাল ইনস্পেকশন সেন্টার (ভিআইসি) নামে একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দিয়ে ফিটনেস পরীক্ষা নেয়া শুরু করেছিল বিআরটিএ। এ যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষার সময় ৭০ শতাংশ যান্ত্রিক যানই ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সে সময় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় বিআরটিএ মিরপুর ও ইকুরিয়াসহ পাঁচ কার্যালয়ে ভিআইসি যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। অভিযোগ আছে, যন্ত্রগুলো কয়েক মাসের মধ্যে অকেজো করে ফেলা হয়। বিআরটিএ সূত্র জানায়, প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি যন্ত্র বসানো হয়েছিল। এর মধ্যে মিরপুর কার্যালয়ে স্থাপিত যন্ত্রটি কেনা হয়েছিল ৪০ কোটি টাকায়। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় যন্ত্রগুলো প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে, যে কারণে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। জানা গেছে, অধিকাংশ গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হয় বিআরটিএ’র ঢাকা ও চট্টগ্রাম অফিস থেকে। যদিও এখন সকল বিভাগীয় শহরে এ হার কিছুটা বেড়েছে। দেশের যে কোন স্থানে গাড়ি চললেও প্রতি বছর ফিটনেস নবায়ন করতে রেজিস্টার্ড অফিসে হাজির হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গ্রাহক ভোগান্তি কমাতে বিআরটিএ চাইছে চলাচলরত গাড়ির নিকটবর্তী অফিসে ফিটনেস পরীক্ষার সুযোগ দিতে। এতে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে। কিন্তু এ নিয়ে পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের সংশোধন করতে হবে। তাই এ সংক্রান্ত নির্দেশনা চেয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ নেয়া হবে। জানা গেছে, যন্ত্রের সাহায্যে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষার বিষয়টি কার্যকর করতে মিরপুর বিআরটিএ অফিসে ভেহিক্যাল ইনস্পেকশন সেন্টার (ভিআইসি) শীঘ্রই চালু হচ্ছে। ফলে গাড়ির মান যাচাই নিয়ে অনিয়মের সুযোগ কমে যাবে। ইতোমধ্যে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোইকার সহায়তায় অচল যন্ত্রটি মেরামত করা হয়েছে। একই প্রকল্পের আওতায় ওয়েব পোর্টালের সক্ষমতা পাচ্ছে বিআরটিএ। থাকবে আইসিটি ইউনিটও। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মেশিনগুলো বিআরটিএ বিভিন্ন কার্যালয়ে স্থাপনের পর থেকে এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা এর বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে মোটরযান পরিদর্শকরা মেশিনের মাধ্যমে ভুল রিপোর্ট আসার কথা বারবারই বলেন কর্মকর্তাদের কাছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন উচ্চপদস্থ অনেক কর্তাব্যক্তিই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, মোটরযান পরিদর্শকের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি নতুন কোন ঘটনা নয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিআরটিএসহ টাস্কফোর্সের অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানটিতে তিন শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত করা হয়। ৩১ শীর্ষ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার তালিকা করে টাস্কফোর্স। তাদের মধ্যে চারজনই ছিলেন মোটরযান পরিদর্শক। সাতজন ট্রুথ কমিশনে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন। একজনকে ৩০ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। গত বছর নারায়ণগঞ্জে মোটরযান পরিদর্শক আবু নাঈম ও অহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পরিবহনের শ্রমিক সংগঠনসহ নাগরিক সমাজ দু’জনের অপসারণ দাবি করে। বরিশালের বিআরটিএ অফিসের মোটরযান পরিদর্শক আইয়ূব আনসারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শেষে অভিযোগ নথিভুক্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন। চলছে খেলাপী গাড়ি ॥ বিআরটিএ সূত্রমতে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৯৭৯ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি খেলাপী অবস্থায় রাস্তায় চলাচল করছে। বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী ৩৩ শতাংশ যানবাহনেরই কোন ফিটনেস সনদ নেই। এতে একদিকে মোটরযান কর ও ফি খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে এসব যানবাহন সড়কপথে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে। তাই জরিমানা মওকুফের সুযোগ দিয়ে কাগজপত্র হালনাগাদের আওতায় আনতে চাইছে বিআরটিএ। চোখের দেখায় ফিটনেস ॥ বাংলাদেশে ম্যানুয়ালি গাড়ির ফিটনেস দেয়া হয়। এভাবে খালি চোখে অনেক যন্ত্রের ফিটনেস যথাযথভাবে দেখা যায় না। অনেকটাই অনুমাননির্ভর মোটরযান পরিদর্শকরা গাড়ির ফিটনেস সনদ দিয়ে যাচ্ছেন। পদ্ধতিগত দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক ত্রুটিপূর্ণ গাড়িও অনেক সময় ফিটনেস সার্টিফিকেট পেয়ে যায়। আর গাড়ি না নিয়ে এসে টাকা দিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নেয়ার ঘটনাও হরহামেশাই ঘটছিল। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জানান, একটি গাড়ির ফিটনেস চেক করতে ডিজিটাল ভেহিক্যাল ইনস্পেকশন (ভিআইসি) পদ্ধতিতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগবে। এতে দুই লেন করা হয়েছে তাই একই সঙ্গে একই সময়ে চলবে দুটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা। ঘণ্টায় করা যাবে আটটি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা। এতে দিনে অর্ধশত গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা সম্ভব। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, ম্যানুয়ালি ব্রেক, বডি, সিট, হেডলাইট দেখে ফিটনেস পরীক্ষা করা হয়। আর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রথমেই জ্বালানি টেস্ট, এরপর স্পিড, হেডলাইট, ব্যালান্স চেক করা হবে। পাঁচ থেকে ছয়টি টেস্ট সম্পন্ন হওয়ার পর মনিটর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ফল দেখাবে। সে অনুসারে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেখাবে। বিআরটিএ সচিব জানান, খালি চোখে গাড়ির ফিটনেস দেয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক ত্রুটি থেকে যায়। এভাবে গাড়ির জ্বালানি (সিলিন্ডার) পরীক্ষা করা যেত না। যা দেখা হতো তা ওই খালি চোখে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্যাস সিলিন্ডার ঠিক আছে কি-না তা পরীক্ষা করা হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, কোরিয়ান এ প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বিআরটিএ’র ১৫ পরিদর্শক। দেশে এবং কোরিয়াতে এ প্রশিক্ষণ হয়েছে। আরও কয়েকজনকে দক্ষ করে তুলতে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, ঢাকা অফিসে ভিআইসি মেশিনের কার্যক্রম শুরুর পর পর্যায়ক্রমে ইকুরিয়া, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় চালু করা হবে। শুরু হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতির ফিটনেস টেস্ট ॥ ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আসছে যানবাহনের ফিটনেস টেস্ট। এ লক্ষ্যে মিরপুরে স্থাপন করা হয়েছে ভেহিক্যল ইনস্পেকশন সেন্টার বা ভিআইসি। আগামী ৩০ অক্টোবর ভিআইসি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দেশের পরিবহন ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, ভিআইসি চালু হলে ফিটনেস টেস্টের জন্য যানবাহন বাধ্যতামূলকভাবে রেজিস্ট্রেশন সেন্টারে আনতে হবে। বর্তমানে ম্যানুয়েল পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল টেস্ট চালু হলে যানবাহন ব্যবস্থাপনায় আরও অগ্রগতি হবে বলে তিনি এ সময় সেবাগ্রহীতাদের জানান।
×