ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

চীনা প্রেসিডেন্টের সফর

একুশ প্রকল্পের বিপরীতে ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন চায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৯ অক্টোবর ২০১৬

একুশ প্রকল্পের বিপরীতে ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন চায় বাংলাদেশ

এম শাহজাহান ॥ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগামী ১৪ অক্টোবর দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন। তাঁর ওই সফরের সময় ২১টি প্রকল্পের বিপরীতে ২০ বিলিয়ন ডলারের চীনা অর্থায়ন নিশ্চিত করতে চায় বাংলাদেশ। এসব প্রকল্পে সহযোগিতা পেতে এরই মধ্যে চীন সরকারকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে চীনের রাষ্ট্রদূত লি গুয়ানজুর মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের জন্য ২১টি প্রকল্প যাচাই-বাছাই করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রেল খাতের চারটি, সড়ক পরিবহনের চারটি, বিদ্যুতের চারটি, জীবনমান উন্নয়নে পাঁচটি, জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি করে এবং শিল্প খাতের দুটি প্রকল্প রয়েছে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে আগ্রহী চীন। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দুই দেশ এফটিএ সই করলে তাদের অনুকূলে থাকা বৈষম্যমূলক বাণিজ্যে যৌক্তিকভাবে ভারসাম্য আনা যাবে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-বিনিয়োগ সংক্রান্ত যতগুলো চুক্তি হয়েছে তা বাস্তবায়নেও এবার জোর দেয়া হবে। এ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে ১৭টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। এসব চুক্তির মধ্যে রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, কর্ণফুলী নদীর ওপর প্রস্তাবিত দ্বিতীয় রেল সেতু, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ভায়া রামু ও রামু থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুনধুম পর্যন্ত প্রস্তাবিত ডুয়েল গেজের রেললাইন নির্মাণ এবং তৃতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি নেটওয়ার্কের সহায়তা প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে এসব চুক্তির তেমন কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। এই বাস্তবতায় এবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার নিয়ে গঠিত (বিসিআইএম) ফোরাম কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। নতুন কানেকটিভিটি চালু হবে এই চার দেশের মধ্যে। এতে করে বাড়বে আঞ্চলিক বাণিজ্য। জানা গেছে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফর সামনে রেখে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সমন্বয় সভা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সফর-সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, রাষ্ট্রীয় সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসছেন। চীনের প্রেসিডেন্টের সফরকালে অন্তত ২১টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ, যার অর্ধেকই মেগা প্রকল্প-সংক্রান্ত। প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্টের এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে ১৯৮৬ সালে চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন। যদিও ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় শি জিন পিং ২০১০ সালে দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এদিকে চীনের ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ থেকে দেড় শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়টি তুলবে বাংলাদেশ। এছাড়া বৃহদায়তন প্রকল্পে চীনের অর্থায়নসহ দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য বৈষম্য কমাতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হবে। শিল্প উৎপাদনবিষয়ক রূপরেখা চুক্তি এবং বিনিয়োগ ও উৎপাদনবিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক ছাড়াও যেসব এমওইউ সইয়ের প্রস্তুতি চলছে, তার মধ্যে অর্ধেক প্রকল্প-সংক্রান্ত এবং বাকিগুলো নীতিবিষয়ক। প্রকল্পগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকু- থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ ও উপকূল রক্ষা বাঁধ, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ, বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের প্রিপেইড মিটার প্রকল্প, মংলা বন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি উন্নয়ন, ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ফোর লেনে উন্নীতকরণ, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, এবং কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী স্যাটেলাইট টাউন গড়ে তোলার মেগা প্রকল্পগুলো রয়েছে। এছাড়া কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী এলাকায় (টানেলের কাছাকাছি) চীনের বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বড় বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা আসতে পারে। কর্ণফুলী নদীর নিচে চীনের অর্থায়নে নির্মিতব্য বাংলাদেশের প্রথম টানেলের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন হতে পারে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ চীন সফরের সময়ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য সম্পর্ক জোরালো করার লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে পাঁচটি চুক্তি করা হয়। এর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার নিশ্চয়তার কথা বলা হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী চীন প্রতিবছর বাংলাদেশকে ৩০০ মিলিয়ন চীনা মুদ্রা সহায়তা দেয়ার কথা। চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন এবং নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, চট্টগ্রামে চাইনিজ ইকোনমিক এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট জোন নির্মাণে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য দুর্যোগকালে দ্বিতীয় দফায় ব্যবহৃত উদ্ধারকারী যন্ত্র ক্রয় ও ব্যবহারে সহায়তা ও কর্ণফুলী নদীতে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল নির্মাণে সমঝোতা স্মারক করা হয়। এসব চুক্তি বাস্তবায়নেও এবার তৎপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। জানা গেছে, চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম তৃতীয় বাণিজ্যিক অংশীদার ও আমদানির উৎসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ বাণিজ্য খুবই ভারসাম্যহীন। ৯ বিলিয়ন ডলারের বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে চীনে রফতানি বাড়ানোর পাশাপাশি এদেশে তাদের বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকার এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে। এক্ষেত্রে ভারত, চীন এবং জাপানের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত যতগুলো চুক্তি রয়েছে সরকার তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায়। রূপকল্প-২১ এবং দেশকে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে নিতে হলে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। তাই উল্লিখিত এসব দেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এদেশে এখন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। এদিকে বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে জানা যায়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে। তবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের প্রায় পুরোটাই চীন থেকে আমদানির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। রফতানির পরিমাণ খুব সামান্য। চীন হচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আমদানিকারক দেশ। দেশের মোট আমদানির ১৮-২০ শতাংশ আসে চীন থেকে।
×