ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, দেখার কেউ নেই

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৮ অক্টোবর ২০১৬

ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, দেখার কেউ নেই

রাজন ভট্টাচার্য ॥ একটি বেসরকারী ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন। রাজধানীর পল্টন থেকে যাবেন গুলশান দুই নম্বর পর্যন্ত। এসি বাসের অপেক্ষায় আধাঘণ্টা সময় নষ্ট। জানতে পারলেন রাজধানীতে এসি বাসের এখন আর চল নেই বললেই চলে। এবার ট্যাক্সির অপেক্ষা! এ তো সোনার হরিণ। অন্তত ১৫টি অটোরিক্সাচালকের সঙ্গে কথা হয় তার। এর মধ্যে ১০ জনই যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বাকি পাঁচজনের কেউই মিটারে যেতে নারাজ। যাবেন চুক্তিতে। শেষপর্যন্ত ব্যাংক কর্মকর্তার বৈঠকে আর যোগ দেয়া হলো না। নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিটি ক্ষেত্রে এ রকম সমস্যার কমতি নেই। উন্নত পরিবহন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক-মহাসড়ক, চালক, ব্যবস্থাপনা, আইনের প্রয়োগ সবখানেই ত্রুটি রয়েছে। বস্তুত নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই। বিচ্ছিন্নভাবে প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে; তাও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে বিবেচনায় দেশে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। এর কারণ হিসেবে সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের অভাবকেই দায়ী করছেন তারা। সেই সঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে সরকারী-বেসরকারীভাবে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন এ সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা। সড়কে নানা সমস্যা ॥ পরিসংখ্যান বলছে, জাতীয় মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনা বেশি হয়। সড়কে নিরাপত্তার অভাব যথেষ্ট। নিরাপত্তার প্রয়োজনে সড়কে যেসব ব্যবস্থা নেয়া জরুরী এর তেমন কোনকিছুই হচ্ছে না। তবে নানা আলোচনা ও সমালোচার মুখে সড়কের অবস্থা দিন দিন কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। দুটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করে এর মাঝখানে সড়ক বিভাজক দেয়া হয়েছে। এতে মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা কমেছে। সরকার দুর্ঘটনা কমাতে ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সোজা করার প্রকল্প অনুমোদন করলেও কাজের গতি কম। তবে এখনও অনেক সড়ক ভাঙ্গাচোরা, সঙ্কেতও ঠিকভাবে নেই। স্কুল, বাজার, হাসপাতাল, জেব্রাক্রসিং, নীরব ও আবাসিক এলাকা এর কোন সঙ্কেত সঠিকভাবে টানানো হয়নি। উন্নত বাস টার্মিনাল, সড়কে যাত্রী ছাউনি বা রাস্তা পারাপারের জন্য ওভারব্রিজ, জেব্রাক্রসিংয়ের কোনকিছুই প্রয়োজনীয় নয়। রাজধানী থেকে শুরু করে আন্তঃজেলা রুটে বাসের ছাদে যাত্রী পরিবহনের দৃশ্য সব সময়ের। এমনকি পণ্যবাহী পরিবহনেও যাত্রী পরিবহন হচ্ছে ইচ্ছেমতো। মানহীন লক্কড়ঝক্কড় পরিবহন চলছে জাতীয় মহাসড়ক থেকে শুরু করে সবখানেই। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, যেগুলো লাগানো রয়েছে এর বেশির ভাগের সঙ্গে চালকরা পরিচিত নয়। সড়কের পাশে অনুমোদন না নিয়েই টানানো হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড; যা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে চালকদের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সকল সড়কে বিভাজক নির্মাণ, সড়কের পরিধি বাড়ানো, ভাঙাচোরা রাস্তা সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক নিরাপত্তার জন্য হাইওয়ে পুলিশ, শিল্প পুলিশ, জেলা পুলিশ, মহানগর পুলিশ কোন না কোনভাবে কাজ করছে। তবুও রাস্তায় অরাজকতার শেষ নেই। যেখানে সেখানে টার্মিনাল, বাজার, দখল চোখে পড়ে। বন্ধ হলো না স্বল্পগতির যানবাহন ॥ সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহনের দৌরাত্ম্য। উন্নত দেশগুলোর জাতীয় মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলে পৃথক লেনের ব্যবস্থা রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার স্বল্পগতির যানবাহন মহাসড়কে চলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সর্বশেষ ডিসি সম্মেলনেও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বাস্তবায়ন নিয়েও কিছুটা জটিলতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মহাসড়কগুলোতে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলে পৃথক লেনের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এখন সমস্যা হলো এক উপজেলা কিংবা জেলা শহর থেকে পার্শ্ববর্তী স্থানে যেতে মহাসড়ক ব্যবহার করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। স্বল্প দূরত্ব হওয়ায় নেই বাস যোগাযোগও। এমন বাস্তবতায় অযান্ত্রিক কিংবা স্বল্পগতির যানবাহনে চলাচল ছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। বিকল্প সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি মহাসড়কের সঙ্গে কমগতির যানবাহন চলাচলে পৃথক লেন নির্মাণ এখন সময়ের দাবি। গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ॥ সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে হাইওয়ে পুলিশের কাছে আছে স্পিড ডিটেক্টর। যার কাজ গাড়ির গতি পরিমাপ করা। ফলে কোন গাড়ি নির্ধারিত সীমার বাইরে বেপরোয়া গতিতে চালালে পুলিশ চালকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলোÑ ‘কাজীর গরু শুধু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।’ স্পিড ডিটেক্টর আছে, ব্যবহার নেই। ঈদের সময় দুর্ঘটনাকবলিত মহাসড়কগুলোয় এ যন্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি। সূত্র বলছে, সারাদেশে হাইওয়ে পুলিশের কাছে আছে মাত্র ১০৫টি স্পিড ডিটেক্টর। এর মধ্যে নষ্ট ২৫টি। বাকি ৮০টি দিয়ে কাজ চলছে কোনমতে। অথচ সব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মহাসড়কে স্পিড ডিটেক্টর প্রয়োজন। জানা গেছে, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ঈদের আগে ও পরে বেশিরভাগ স্থানে স্পিড ডিটেক্টর ব্যবহার হয়নি। গাড়ির গতিবেগ নির্ণয়কারী এ যন্ত্রটি ব্যবহার না করার সুযোগে মহাসড়কে নির্ধারিত সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিসীমায় গাড়ি চালিয়েছে বেশিরভাগ চালক। গতি নিয়ন্ত্রণ ও চালকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই ॥ বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৩তম সভায় মহাসড়কে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এছাড়া প্রতি পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর চালককে আধাঘণ্টা বিশ্রাম এবং দিনে সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। পুলিশ এবং মালিক ও শ্রমিককে এ বিধান প্রতিপালনের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা করছে না পুলিশ এবং মালিক-শ্রমিকরা। সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করার কোন ব্যবস্থা নেই। হাইওয়েতে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হাইওয়ে পুলিশ করে থাকে, সেখানে বিআরটিএর সর্বক্ষণিক কোন কার্যক্রম নেই। এছাড়া আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট কমিটির প্রধান মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনার ও জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক। ওই কমিটিতে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা সদস্য হিসেবে রয়েছেন। তারাই সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। সেগুলোও যথাযথ হচ্ছে না। থামছে না দুর্ঘটনা ॥ জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সালকে ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ১০ বছরে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি। যদিও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বরাবরই বলে আসছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কমেছে। দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে আলাদা বাজেটও নেই। এভাবে দুর্ঘটনা কমানো যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর ২১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। তবে বাংলাদেশের যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে একই বছরে এ সংখ্যা সাড়ে আট হাজার। তারা মূলত সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে। আর সরকারী হিসাবে প্রাণহানির সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৩৭৬। সহজেই মিলছে ভারি চালকের সনদ ॥ বিআরটিএ’র তথ্য অনুসারে, দেশে ভারি যানবাহনের প্রায় আড়াই লাখ চালক রয়েছেন। তাঁদের ১ লাখ ৯০ হাজার লাইসেন্স পেয়েছেন পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে। তাঁরা লাইসেন্স পান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের দেয়া তালিকা ধরে। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, তিন ধরনের লাইসেন্স দেয়া বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। এর কোনটিরই সঠিক মান যাচাই করা হয় না। বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে প্রায় ২৭ লাখ। এর মধ্যে অন্তত ৪ লাখের ফিটনেস সনদ নেই। আর যেসব যানের সনদ আছে, সেগুলোর বেশিরভাগকে দেয়া হয়েছে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। কারণ, মোটরযান আইনে যানবাহনের ৫০টির বেশি কারিগরি পরীক্ষা নিশ্চিত করেই চলাচলের সনদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব যাচাই করা হয় যন্ত্রের সাহায্যে। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনার অভাব ॥ নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। যা আছে বিচ্ছিন্ন পরিকল্পনার অংশ। এর মধ্যে যেসব পরিকল্পনা নেয়া হয় তাও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে খুব কমই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশী কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে যোগাযোগ খাতের প্রকল্পে মান নিয়ন্ত্রণের দিক বিবেচনায় ভাল। কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে সেরকম মান লক্ষ্য করা যায় না। পাশাপাশি উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু, বাস স্টপেজ নির্মাণ, যাত্রী নিরাপত্তা, সড়ক আইন, দক্ষ চালকসহ সার্বিকভাবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক পিছিয়ে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ সড়ক যোগাযোগের জন্য এডুকেশন-ইঞ্জিনিয়ারিং ও এ্যানফোর্সমেন্ট খুবই জরুরী। এর মধ্যে আমাদের দেশে সড়ক নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় ইঞ্জিনিয়ারিং দিকটি ভাল। অন্য দুটির অবস্থা বেহাল বলা চলে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ট্রাফিক রুলস চালকসহ যাত্রী ও সাধারণ মানুষ খুবই কম জানে। অবৈধ পার্কিং, রাস্তার পাশে বাজারসহ স্থাপনা, উন্নত পরিবহন এর কোন কিছুই মানের দিক থেকে সন্তোষজনক নয়। পাশাপাশি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এ্যানফোর্সমেন্টও যথাযথ হচ্ছে না। ফলে অরাজকতা চলছেই। অথচ প্রয়োজনীয় আইন আছে। নানা কারণে তা প্রয়োগ হচ্ছে না। নিরাপদ সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদ-ে আমাদের অবস্থান খুবই নাজুক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী। বিচ্ছিন্নভাবে উদ্যোগ নিয়ে মান উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই কঠিন হবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর দু’পাশের সংযোগ সড়কগুলো মানসম্পন্ন হয়েছে। কারণ বিদেশী অর্থায়নে এই প্রকল্পটি করা হয়েছে। কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে যোগাযোগ খাতের প্রকল্পগুলোর মান খুব একটা উন্নত হয় না। জানতে চাইলে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তবে সঙ্কট অনেক। এর মধ্যে যতটুকু সম্ভব কাজ হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও সেবার মান বাড়বে বলে জানান তিনি। বলেন, সড়ক নিরাপদ করার জন্য দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করেছি। সবার কথা একটাইÑ দুর্ঘটনার জন্য মূলত চালকরাই দায়ী। বেপরোয়া চালানোর কারণেই বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, সম্প্রতি সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে ৮০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি না চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই নির্দেশনা কেউ মানে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এসব পরিকল্পনাসমূহের মধ্যে রয়েছে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো রোধ ও মাদকাসক্ত চালক নিয়োগ না দিতে মালিকদের কঠোরভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া মোবাইল কোর্টেও কার্যক্রম বৃদ্ধি, সংবাদ মাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার, সতর্কবার্তা দেয়া। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও কঠোর নজরদারি বাড়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। পরিবহন সঙ্কট ॥ প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা। প্রতিদিন রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলো থেকে নানা প্রয়োজনে রাজধানীতে আসে আরও অন্তত ২০ লাখ মানুষ। অথচ এত মানুষের শহরে বিআরটিএ হিসাব অনুযায়ী পরিবহন আছে সাড়ে নয় লাখ। কিন্তু বিলাশ পরিবহনের মধ্যে গণপরিবহনের সংখ্যা কত? এই সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক। বাসের সংখ্যা সর্বোচ্চ সাত হাজার। ট্যাক্সিক্যাব অর্ধশতরও কম। তালিকাভুক্ত অটোরিক্সার সংখ্যা মাত্র ১৩ হাজার। সব মিলিয়ে গণপরিবহন ২০ হাজার মাত্র। সবচেয়ে বেশি চলছে ব্যক্তিগত পরিবহন। এর মধ্যে প্রাইভেটকারের সংখ্যা বেশি। এরপর মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য পরিবহন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি রাজধানী শহরের যে পরিমাণ গণপরিবহন চলাচল করছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। যেসব গণপরিবহন চলছে সেগুলোও মান সম্পন্ন নয়। লক্কড় ঝক্কড় গণপরিবহনের সংখ্যা বেশি। বাসের আসনগুলোতে ময়লা জমতে জমতে নাজুক অবস্থা। দুর্গন্ধ। ফ্যানের ব্যবস্থাও নেই। জানালার গ্লাস নেই অনেক বাসের। কোন কোন ক্ষেত্রে গ্লাস ভাঙা। সামনের কাচটিও ভাঙা অবস্থায় দেখা যায়। ম্যাক্সি, লেগুনা সেগুলোর মানও নাজুক। জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এজন্য সরকারের উচিত একটি রোডম্যাপ তৈরি করা। সে অনুযায়ী সরকারী ও বেসরকারী সেক্টর মিলিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে সামনের দিকে যাওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, রাজধানীতে উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। তিন হাজার উন্নতমানের নতুন বাস নামানোর পরিকল্পনা থেমে আছে। বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবদুল মোতালেব রাজধানীতে উন্নত কোন পরিবহন ব্যবস্থা না থাকার কথা জানিয়ে বলেন, এজন্য মূল সমস্যা হলো সমন্বয়হীনতা। শহরে কিছু অটোরিক্সা আছে সেগুলো আইন মেনে চলে না। ট্যাক্সিক্যাব সোনার হরিন। বাসে ওঠার কোন পরিবেশ নেই। এই শহরে আইন না মানার প্রবণতা অনেক বেশি। সব মিলিয়ে সড়ক নিরাপত্তার মান খুবই দুর্বল। তিনি বলেন, চালকদের দিয়ে যত্রতত্র গাড়ি চালানোর অনুমোদন বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দিন দিন ভুয়া চালকদের সংখ্যা বাড়ছে। দিনে ৩০০ ভারি পরিবহন রাস্তায় নামার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যত গাড়ি নামছে তত চালক সৃষ্টি হচ্ছে না। পাশাপাশি চালকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনীয় মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই লাইসেন্স মিলছে। মহাসড়কের পাশে অবৈধ দখলের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, উন্নত দেশে এরকম চিত্র লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে সব সড়কের পাশেই দখলের দৃশ্য। সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো পরিবহন আইন সময় উপযোগী নয়। প্রয়োজনীয় নজরদারির যথেষ্ট অভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রয়োজন ফোর লেন ॥ জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এম সাহাবুদ্দিন খান জনকণ্ঠকে বলেন, সড়ক নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ারিং অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে জাতীয় সব সড়ক ডিভাইডারসহ ফোর লেন করার বিকল্প নেই। মহাসড়কের বাঁক সোজা করতে হবে। যা ইতোমধ্যে চলমান। বাংলাদেশসহ এশিয়ার সড়কগুলোতে বাঁক বেশি থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঁকগুলোতে নিরাপত্তার বিষয়টি চালকের মাথায় রেখে গাড়ি চালানো উচিত। আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে কোন অবস্থাতেই গাড়ি চালানো যাবে না। কিন্তু এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। যাত্রী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিকভাবে উপযোগী ব্যক্তিকে সকল নিয়ম-কানুন নিশ্চিত করে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া উচিত। জাতীয় মহাসড়কে অল্প গতির যানবাহন বন্ধ ও শ্লো মোভিং ভেহিক্যালের জন্য পৃথক লেন নিশ্চিত করারও পরামর্শ দেন এই প্রকৌশলী। উন্নত দেশগুলোতে ১০-১৬ লেনের সড়কের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সড়কের পরিধি খুবই কম। বেশিরভাগ সড়ক দুই লেনের। দুই লেনের সড়কে কোন অবস্থাতেই মাঝখানের দাগের বাইরে গাড়ি চালানো যাবে না। ইচ্ছামতো লেন পরিবর্তন করা মানের দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। সড়কে ত্রুটিমুক্ত গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সড়কে রোড সাইন, সিগন্যাল, রোড মার্কিংসহ সকল সতর্কতা মেনে চলা উচিত। এগুলো নিশ্চিত করতে চালকসহ সড়ক বিভাগের কিছুটা গাফিলতি রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। মহাসড়কে চলা যাত্রীদের সিটবেল্ড বাঁধা বাধ্যতামূলক করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুও কারণ হিসেবে মাথায় আঘাত লাগার বিষয়টি ওঠে এসেছে। তাই সিটবেল্ড বাঁধা নিশ্চিত হলে যাত্রীসহ চালকের মাথায় আঘাতের সম্ভাবনা কম থাকে। সড়কের দু’পাশে সাইনবোর্ড ও নিয়ন সাইনে আপত্তিকর কিছু প্রদর্শন করা যাবে না। এদিকে চালকের দৃষ্টি গেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ১৯২৫ সালের হাইওয়ে আইনে রাস্তার সড়ক ও জনপথের জায়গা থেকে ১০ মিটারের মধ্যে কোন স্থাপনা নিষিদ্ধ। এই ৩০ ফুট জমি খালি রাখার কথা থাকলেও দেখা যায় সওজের জমিতেও অবৈধ স্থাপনা হয়েছে। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, যানবাহনে ত্রুটি, চালকের অসতর্কতা, সড়কের ত্রুটি ও ইচ্ছামতো পথচারীদের রাস্তা পারাপার সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন এই প্রকৌশলী। তিনি বলেন, আমি মনে করি এসব সমস্যা সমাধান করা গেলে সড়কে ৯০ ভাগের বেশি সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে।
×