ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামের স্কুলে উপজেলা প্রশাসন দিচ্ছে শিশুদের খেলার সামগ্রী

বিরল দৃষ্টান্ত, প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে নেয়ার নতুন অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

বিরল দৃষ্টান্ত, প্রাথমিক শিক্ষা এগিয়ে নেয়ার নতুন অধ্যায়

সমুদ্র হক ॥ প্রত্যন্ত গ্রামের সরকারী প্রাথমিক স্কুলগুলোতে শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের মাধ্যমে মননশীলতা বাড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায়। বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেখানে, যা দেশে এই প্রথম। অভিভাবক, স্থানীয় শিক্ষা বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন বলেছে, সারাদেশে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিবগঞ্জের মডেলটি বাস্তবায়ন করা যায়। সারাদেশের উপজেলার নিজস্ব ফান্ড থেকেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়, যেভাবে শিবগঞ্জের উপজেলা ফান্ড থেকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সৃষ্টিশীল এই কাজের উদ্ভাবক শিবগঞ্জের বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ আমিনুর রহমান। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে উপজেলার ৭৮টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় চত্বরে শিশু বিনোদনের খেলনা সামগ্রী স্থাপন করেছেন। সীমিত সাধ্যের মধ্যে শুধু উদ্যোগী হলেই যে এই কাজ করা সম্ভব তার প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। ইউএনও মোঃ আমিনুর রহমান জানান, সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান ফলাফল ডিসিপ্লিনের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে ৭৮টি স্কুল নির্বাচিত করে খেলনা স্থাপিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার ১শ’ ৬০ সরকারী প্রাথমিক স্কুলে খেলনা সামগ্রী স্থাপিত হবে। প্রতি সেট খেলনার মধ্যে আছে- একটি দোলনা একটি ঢেঁকি ও একটি সিøপার। খেলনাগুলো স্কুলে স্থাপনের পর আশপাশের দশগ্রামে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। গ্রামের যে শিশুরা শহরে বেড়াতে গিয়ে এসব খেলনা পার্কে দেখেছে সেই খেলনা এখন তাদের ঘরের দুয়ারেই প্রাথমিক স্কুলে। প্রত্যন্ত গ্রামের এসব সরকারী প্রাথমিক স্কুলে আগে বিনোদনের এ ধরনের সামগ্রী ছিল না। গ্রামের স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শিক্ষকগণ কখনও আশা করেননি তারা এই খেলনাগুলো পাবে। তারা কখনও এমন খেলনা স্থাপনের কথাও ভাবেননি। শিবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম মাঝিহট্ট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় শিশুদের মনে কি আনন্দ কি উচ্ছ্বাস। খেলনাগুলো স্থাপনের পরে এই স্কুলের শিক্ষার মান আগের চেয়ে এগিয়ে গেছে। আগে এই স্কুলে শিশুদের উপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না। বর্তমানে শত ভাগ উপস্থিতি। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে চিন্তামুক্ত থাকে। শিশু বিনোদনের এই খেলনাগুলো স্থাপনের পর শিশুদের মননশীলতা বেড়ে গিয়েছে। স্কুলের একজন শিক্ষক বললেন, খেলনাগুলো স্থাপনের পর পরোক্ষভাবে শিশুদের শারীরিক গঠনে বড় সহায়ক হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল সময়ের অনেকটা সময় আগে এসে খেলনাগুলোয় খেলাধুলা করে। ফ্রেশ মন নিয়ে পাঠ গ্রহণ করে। আবার স্কুল ছুটির পরও কিছুটা সময় খেলে। এভাবে কোমলমতি শিশুরা স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়েই বেড়ে উঠছে। শিবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে অনেকটা দূরের ময়দানহাটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিছুটা অনগ্রসর এলাকার এই স্কুলে শিশুদের দোলনা সিøপার ঢেঁকি পৌঁছাবার পর গ্রামের লোক প্রথমে বিস্মিত হয়েছে। এলাকার কয়েক ব্যক্তি বললেন, তারা স্বপ্নেও দেখেননি শহরের পার্কের এমন খেলনা অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলে পৌঁছবে। স্কুলের শিক্ষকগণ জানালেন, এই খেলনা শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার কমিয়ে দিয়েছে। আগে অনেক শিশু পাঠে অমনযোগী হতো। খেলনাগুলো আসার পর শিশুদের বলা হয়েছে যে শিশু পড়া ভাল পারবে তাকে অনেকক্ষণ খেলনায় খেলার সুযোগ দেয়া হবে। এই খেলনার আকর্ষণে আগামীতে শিশু ভর্তির হার বেড়ে যাবে, এমনটিই মনে করেন শিক্ষকগণ। শিবগঞ্জের বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। বললেন সরকারী প্রাথমিক স্কুলগুলোকে কীভাবে আরও ডায়নামিক করে শিশুর মেধা বিকাশে পুঁথিগত বিদ্যাকে সহায়তা দেয়া যায় সেই ভাবনা থেকে স্কুল শিশু খেলনা স্থাপন। তিনি মনে করেন লেখাপড়ার সঙ্গে শিশুর মনকে ক্রিয়েটিভিটি তৈরিতে এসব খেলনা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্কুলের ক্লাস করা আর স্কুল কম্পাউন্ডে নিজেদের মতো করে খেলাধুলা ছাড়া আর কিছু পায় না। সেখানে খেলনার উন্নত এই সরঞ্জামগুলো তাদের মনকেও আরও উন্নত করবে। শহরের পার্কে গিয়ে খেলতে পারে না এমন হীনমন্যতা দূর হবে। খেলনা সরঞ্জাম দেয়ার জন্য তিনি সরকারী প্রাথমিক স্কুল বেছে নেন এভাবে- যে স্কুলে পাঠদানের মান ও ফলাফল ভাল, যে স্কুলে ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায়, যে স্কুলগুলোতে নারী শিক্ষাকে অধিক অগ্রাধিকার দেয়া হয় সেই সব স্কুলে তিনটির (সিøপার, ঢেঁকি ও দোলনা) একটি করে সেট স্থাপন করে দেয়া হয়। ১২টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত শিবগঞ্জে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১শ’ ৬০টি। এর মধ্যে শিক্ষার মান ও ফলাফল দেখে ৭৮টি স্কুলকে এক সেট করে শিশু খেলনা বিতরণ করা গেছে। বাকি স্কুলগুলোতে পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে। চারজন ঠিকাদার শিশু খেলনার নক্সা অনুসরণ করে বগুড়া ও শিবগঞ্জ থেকে বানিয়ে নিচ্ছেন। তারাই স্কুলে গিয়ে সেট করে আসছেন। ইউএনও প্রতিটি স্কুলে গিয়ে দেখছেন তা ঠিকমতো স্থাপিত হয়েছে কি না। সেট করার পর কোন ত্রুটি দেখা দিলে ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। এগুলো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তারপর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তাবে স্কুল কমিটির ওপর। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল শিবগঞ্জ উপজেলার সকল সরকারী প্রাথমিক স্কুলে বিনোদনের খেলার সামগ্রী স্থাপনের এমন উদ্যোগ দেশের আর কোন উপজেলায় নেই। একজন শিক্ষাবিদ জানালেন এই উদ্যোগ দেশের সকল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেয়া যায়। দেশের সকল উপজেলা প্রশাসন নিজস্ব ফান্ড থেকেই এই উদ্যোগ নিতে পারে। শিবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সেই পথ দেখিয়ে দিয়েছে।
×