ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গী ভেবে প্রস্তুতি, বাস্তবে মোবাইল চোর!

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জঙ্গী ভেবে প্রস্তুতি, বাস্তবে মোবাইল চোর!

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অভিজাত এলাকা গুলশানের একটি ভবনে জঙ্গীদের প্রবেশ করার খবরে রীতিমতো হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত ভবনটিতে চোর প্রবেশ করেছিল বলে নিশ্চিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানে উদ্ধার হয় দুটি ব্যাগ। আর সেই ব্যাগ দুটিতে মিলে এলজি কোম্পানির ১৭টি দামি মোবাইল ফোন। তদন্তে একদল চোর এলজির শোরুমে চুরি করতেই গ্রিল কেটে প্রবেশ করেছিল বলে নিশ্চিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমন খবরের পর মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফেরে। স্বাভাবিক হয় গুলশান এলাকার সার্বিক কার্যক্রম। তবে পলাতকরা প্রকৃত পক্ষেই চোর নাকি কোন জঙ্গী গোষ্ঠীর সদস্য তা নিশ্চিত হতে ভবনটির বাইরে, ভেতরে ও আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তার পর্যালোচনা চলছে। এদিকে ভবনে জঙ্গী প্রবেশের খবর পেয়েই পুলিশ র‌্যাবসহ সকল গোয়েন্দা সংস্থার বিপুল পরিমাণ সদস্য সেখানে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সেখানে হাজির হয়। এমনকি বম্ব ডিসপোটাল ইউনিটও সেখানে অভিযানে নামে। পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পর এমন পরিস্থিতিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও রীতিমতো নড়েচড়ে বসে। আশপাশে থাকা মানুষের মধ্যে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে রীতিমতো তল্লাশি শুরু হয়। টানা প্রায় তিন ঘণ্টা এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করে গুলশানসহ আশপাশের এলাকায়। মঙ্গলবার রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানের এক নম্বর গোলচত্বর এলাকায় অবস্থিত গুলশান এ্যাভিনিউয়ের ৫১ নম্বর সাততলা ভবনে এমন ঘটনা ঘটে। গুলশানের কূটনৈতিকপাড়ার দিকে যেতেই হাতের বাম পাশে নাভানা টাওয়ার ও নাফি টাওয়ারের মাঝখানে অবস্থিত ভবনটি। যেটি এনসিসি ভবন নামে পরিচিত। সাততলা ভবনটির নিচতলায় গাড়ি পার্কিং। দোতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত এলজি কোম্পানির শোরুম। তার উপরে এনসিসি (ন্যাশনাল ক্রেডিট এ্যান্ড কমার্স) ব্যাংক। সবার উপরের তলায় ইউনিরয়্যাল সিকিউরিটি সার্ভিস নামের একটি বেসরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর অফিস। মাঝ বরাবর একটি দেয়াল দিয়ে ভবনটি ভাগ করা। ভবনের সামনের দিকে ব্র্র্যাক ব্যাংকের এটিএম বুথ। বুথটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বেসরকারী নিরাপত্তা বাহিনী এলিট ফোর্সের সদস্য সবুর মোল্যা (৫০) বলছিলেন, প্রতিদিনের মতো সেদিনও তিনি সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে দায়িত্ব পালন করতে সেখানে যান। সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সকাল হওয়ায় রাস্তায় মানুষজন ও গাড়ির সংখ্যা কম ছিল। এরই মধ্যে তালা বা গ্রিল কাটার শব্দের মতো শোনা যাচ্ছিল। আশপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। পাশেই থাকা ভবনটির কলাপসিবল গেটের কাছে তাকাতেই দেখা যায়, কে একজন কাঁধে বড় ভারি ব্যাগ নিয়ে ভেতর থেকেই একটি হ্যাক্সোব্লেড দিয়ে তালা কাটছে। ওই যুবকের বয়স আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর হবে। তিনি ধমক দিয়ে চাবি দিয়ে তালা না খুলে তালা কাটার কারণ জানতে চান। এতে ওই যুবক দ্রুত দৌড়ে উপরে উঠে যায়। তার বেশভুষা দেখে খুবই সন্দেহ হয়। বিষয়টি তিনি আশপাশের বাসিন্দাদের জানান। ততক্ষণে পুলিশের কাছে ওই ভবনে কয়েক জঙ্গী ঢুকে পড়েছে বলে খবর যায়। স্থানীয়রা জানান, এমন খবরে সেখানে দ্রুত পুলিশ হাজির হতে থাকে। এক পর্যায়ে পুরো এলাকা পুলিশে ছেয়ে যায়। রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন ও সন্দেহভাজনদের দেহ তল্লাশি শুরু করে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সেখানে হাজির হয় র‌্যাবের একাধিক টিম। সেইসঙ্গে উর্ধতন কর্মকর্তারাও। পুলিশের সাঁজোয়া যানও সেখানে হাজির হয়। চারদিকে সতর্ক অবস্থায় অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিটি ভবনের সামনে পুলিশ অবস্থান নিয়ে তল্লাশি শুরু করে। এককথায় গুলশান-১ ছাড়াও আশপাশের এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়ে যায়। বিশেষ করে গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর আবারও গুলশানে জঙ্গী হামলার আতঙ্কে ভুগতে থাকেন সেখানকার সবাই। গুলশান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপকমিশনার মানষ কুমার পোদ্দার জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি চুরির ঘটনা। স্থানীয়রা আরও জানান, পুরো এলাকা ঘিরে ফেলার পর অভিযান শুরু করে পুলিশ। আস্তে আস্তে কলাপসিবল গেট খুলে সশস্ত্র অবস্থায় চারদিক দিকে পুলিশ সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিক উঠতে থাকে। পুরো ভবনে তল্লাশি চালানো হয়। পুলিশ বলছে, ভবনটির এমন কোন জায়গা নেই, সেখানে একাধিক বার তল্লাশি চালানো হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোথাও কাউকে পাওয়া যায় না। ভবনটির ছাদে দুটি ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যাগে বোমা বা বিস্ফোরক জাতীয় কিছু থাকতে পারে ভেবে তা বম্ব ডিসপোজাল টিম দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় ব্যাগে বোমা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর ব্যাগে তল্লাশি চালিয়ে এলজি কোম্পানির ১৭টি দামি মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়। সেখানকার বাসিন্দারা বলছিলেন, এমন পরিস্থিতিতে সকাল দশটা পর্যন্ত গুলশানজুড়ে টান টান উত্তেজনা আর আতঙ্ক বিরাজ করছিল। চোরেরা গ্রিল কেটে চুরির জন্য ভবনে প্রবেশ করার খবর প্রকাশের পর আস্তে আস্তে গুলশান এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে। মানুষের মধ্যেও স্বস্তি ফিরে। এরপর রাস্তার বেরিকেড তুলে দেয় পুলিশ। আস্তে আস্তে পুলিশের সংখ্যাও কমতে থাকে। তারপরও বাড়তি সতর্কতার জন্য ভবনটির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে চারজন করে পুলিশকে সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিতে দেখা গেছে। আর নাফি টাওয়ারের সামনে র‌্যাবের দুটি টহল গাড়ি দায়িত্ব পালন করছেন। পাশেই চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে গুলশান মডেল থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নিছক চুরির ঘটনা। চোরেরা মোবাইল ফোন চুরি করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ছাদ থেকে ১৭টি এলজির মোবাইল ফোনসহ দুটি ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি। এ ব্যাপারে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত গুলশানে হলি আর্টিজানের ঘটনার সূত্রধরেই বিষয়টি চুরির ঘটনা হলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। চোরদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। প্রসঙ্গত, ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও বেকারিতে জঙ্গীরা ১৭ জন বিদেশী, দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ও ৩ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী জঙ্গীরা নিহত হয়। ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হন কমান্ডোরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বহু পুরনো ভবনটির পেছন দিক দিয়ে অনায়াসে ভবনটির প্রতিটি তলায় উঠা সম্ভব। চোরেরা হয়ত গ্রিল বেয়ে উপরে উঠেছিল। ভবনের পশ্চিম দিকে একটি জানালার গ্রিল কাটাও দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ভবনটিতে প্রবেশের যথেষ্ট সুযোগ পরিলক্ষিত হয়। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম চোরেরা গ্রিল কেটে ভেতরে প্রবেশ করে, চুরির পর আবার সেই পথেই বেরিয়ে যেত পারত। কিন্তু একজন চোর কেন সামনের কলাপসিবল গেটের তালা কেটে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল? ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যখন চোরেরা বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তখন রীতিমতো সকাল হয়ে গেছে। সকাল প্রায় সাতটা বাজে। এজন্য খুব সম্ভবত একজন চোর সামনের তালা কাটার ভান করে। যাতে মানুষের নজর সামনের দিকে থাকে। আর অন্য চোররা পেছনের কাটা গ্রিল দিয়ে অনায়াসে নেমে যেতে পারে। ভবনের পেছনের নিরাপত্তা প্রহরীরাও যখন দৌড়ে সামনে চলে যায়, তখন গ্রিল কাটার চেষ্টাকারী ওই চোরও ব্যাগ ফেলে আগ থেকেই কেটে রাখা গ্রিল বেয়ে পালিয়ে যায়। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, বিষয়টি আরও গভীরভাবে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কারণ ভবনটিতে ব্যাংক রয়েছে। ইতোপূর্বে আশুলিয়া জেএমবির একটি গ্রুপ ব্যাংক ডাকাতি করে। ডাকাতিকালে ব্যাংক কর্মকর্তা ও জেএমবি সদস্যসহ সাত জনের নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। কোন জঙ্গী গোষ্ঠী ব্যাংকের টাকা লুট করতেই প্রবেশ করেছিল কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে তদন্তে বিষয়টি নিছক চুরির ঘটনা বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তারপরও ভবনটির বাইরে, ভেতরে ও আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে চোরদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
×