ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীদের ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াফতের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৬

জঙ্গীদের ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াফতের উদ্যোগ

রহিম শেখ ॥ দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছয়টি জঙ্গী সংগঠন ও সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকাসহ বিভিন্ন অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতের কাজ শুরু করেছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ইতোমধ্যেই জঙ্গীদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির তথ্য পাঠাতে চিঠি দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এদিকে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়ে দেশের কার্যরত সকল তফসিলি ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুলিশ বলছে, জঙ্গী সংগঠন ও তাদের সহযোগীদের অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতের উদ্যোগ নেয়ার ফলে জঙ্গী কার্যক্রম কমে আসবে। সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর সিরিয়ায় মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হয় বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আইএস জঙ্গী সাইফুল হক সুজন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইবাকস লিমিটেড ও ইবাকসটেল ইলেক্ট্রনিক্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা সে। পরে তার বাবা আবুল হাসানাতকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। ওই সময় হাসানাত জানান, সিরিয়ায় আইএসের প্রধান হ্যাকার সাইফুলের গড়া ইবাকসের ঢাকা কার্যালয়কে সন্ত্রাসবাদে অর্থ আদান-প্রদানের কাজে ব্যবহার করা হতো। সাইফুলের ভাই আতাউল হক বিদেশ থেকে ঢাকা কার্যালয়ের হিসাবরক্ষক নাহিদউদ্দোজা মিয়ার কাছে টাকা পাঠাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নিহত জঙ্গী সাইফুল ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে আটটি ব্যাংকে থাকা মোট ৩৫ হিসাবের তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে ৩০ হিসাবের লেনদেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে স্থগিত করা হয়েছে। এসব হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এসব অর্থ এসেছে মূলত ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাজ্য, সুরিনাম, স্পেন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এসব দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে বিনিয়োগের নামে এ অর্থ পাঠিয়েছে। জঙ্গী কার্যক্রমে সম্পৃত্ত এমন প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ব্যাংক হিসাব জব্দ ও সম্পত্তি বাজেয়াফতের কাজ শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া দেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রেখে জঙ্গী কার্যক্রমে অংশ নিতে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেনÑ এমন ব্যক্তিদের তথ্য খুঁজে বের করে সম্পত্তি বাজেয়াফত করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, জঙ্গী অর্থায়নের উৎসদাতাদের খোঁজ আগেও করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। গত এক বছরে জঙ্গী অর্থায়নের উৎসদাতাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হবে। সূত্রমতে, গত বছরের অক্টোবরে জঙ্গী সংগঠনগুলোর ব্যাংক হিসাব জব্দ ও সম্পত্তি বাজেয়াফতের বিষয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ সদর দফতরকে নিষিদ্ধ ছয় জঙ্গী সংগঠনের ব্যাংক হিসাব বা কোন সম্পত্তি থাকলে তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে বলা হয়। সন্ত্রাসবিরোধী বিধিমালা ২০১৩-এর ৩ ধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা সংগঠনের সম্পত্তি বাজেয়াফত করা যায়। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে গত বছর নিষিদ্ধ করে সরকার। এর আগে দেশে প্রথম ২০০৩ সালে শাহাদাত-ই-আল হিকমা নামে একটি জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৫ সালে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) এবং হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশকে (হুজি-বি) নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিজবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করে সরকার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনগুলোর কোথায় কী অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিভিন্ন সময়ে জঙ্গীদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের নাম বেরিয়ে আসে। জঙ্গী কার্যক্রমে সহযোগী হিসেবে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নানা পেশার ব্যক্তিদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে নির্দেশনা না থাকায় তাদের ব্যাংকে থাকা অর্থসহ বিভিন্ন অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফত করা সম্ভব হয়নি। অথচ এসব অর্থই জঙ্গী কার্যক্রমে ব্যবহারের নজির রয়েছে। জঙ্গী সংগঠন ও তাদের সহযোগীদের অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াফতের উদ্যোগ নেয়ার ফলে জঙ্গী কার্যক্রম কমে আসবে। এদিকে জঙ্গী সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ নামে বা ওই জঙ্গী সংগঠনের অবৈধ কর্মকা-ে অর্থায়নকারীদের কোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে বা কোন সম্পত্তি থাকলে তা বাজেয়াফত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক চিঠিতে এ অনুরোধ জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছেÑ এ জঙ্গী সংগঠনের নামে কোন হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে মানি লন্ডারিং অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ওই হিসাবের লেনদেন ৩০ দিন করে সর্বোচ্চ ২১০ দিন অবরুদ্ধ রাখা যাবে। চিঠিতে আরও বলা হয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচিতিমূলক তথ্য যেমন- নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র এখনও পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে পুলিশের কাছে জঙ্গী কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত এবং গ্রেফতারের পরিচিতিমূলক তথ্য সময়ে সময়ে সরবরাহ করা হলে জঙ্গী অর্থায়ন-বিষয়ক অনুসন্ধান কার্যক্রম অধিকতর কার্যকর করা হবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে কোন হিসাব পরিচালিত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেলে তা যথাসময়ে তাদের জানাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের কার্যরত সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে চিঠি দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত জঙ্গীদের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চিঠিতে গণমাধ্যমে সন্ত্রাস বা জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আসা ব্যক্তি ও সংগঠনের নামে ব্যাংকে কোন হিসাব পাওয়া গেলে তা তাৎক্ষণিক স্থগিতের নির্দেশ দেয়া হয়। কোন গণমাধ্যমের তথ্য বিবেচনায় নেয়া হবে সে সিদ্ধান্তের ভার ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে প্রচলিত আইনে যারা সন্ত্রাসী বা জঙ্গী, তারাই এ আইনের আওতায় পড়বে, বলা হয়েছে চিঠিতে। সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলার ঘটনায় দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়ে বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে যাতে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের অর্থ স্থানান্তরিত না হয় সেজন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) সজাগ থাকার নির্দেশ দেয়া হয় ওই বৈঠকে। পাশাপাশি রেমিটেন্সের প্রকৃত সুবিধাভোগীর তথ্য যাচাইয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংক শাখাগুলো আইনকানুন সঠিকভাবে পরিপালন করছে কিনা, তা যাচাই করে আগামী অক্টোবরের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
×