ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারখানাটি এতদিন কিভাবে চলেছে? তা নিয়ে প্রশ্ন

ডিএপি ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণ

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৭ আগস্ট ২০১৬

ডিএপি ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণ

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ গ্যাসের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার আধুনিক প্রায় সকল সিস্টেমই বিকল। ছিল না নিয়মিত ওভারহোলিং এমনকি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের তদারকি। সনাতন পদ্ধতিতে চলে আসছিল চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রাঙ্গাদিয়ায় অবস্থিত ডাই-এ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) কারখানা। এমন একটি স্পর্শকাতর স্থাপনা কীভাবে বছরের পর বছর অবহেলিত ছিল সেই প্রশ্নে হতবাক তদন্ত টিম। তদন্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত না হলেও এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে যেটুকু জানা যাচ্ছে তা রীতিমত ভয়াবহ। যেভাবে চলছিল তাতে আরও আগে এমনকি এরচেয়েও বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশে অন্যান্য সার কারখানা এবং কেমিক্যাল প্লান্টগুলোও ঠিকঠাক চলছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা সময়ের দাবি। এদিকে, দুর্ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটি দুটির কাজ এগিয়ে চলেছে। শুক্রবারও দিনভর কাজ করেছে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিসিআইসির ১০ সদস্যের কমিটি। ঢাকায় এসে পৌঁছেছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল কমপ্লিট প্লান্ট ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশনের (কমপ্লান্ট) প্রকৌশলীরা। আজ শনিবার তাদের ডিএপি কারখানা পরিদর্শনের কথা রয়েছে। ডিএপির এ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক বিস্ফোরণের তদন্ত এখনও শেষ না হলেও পর্যবেক্ষণ যেটুকু হয়েছে তাতে ঘটনার নেপথ্যে কারিগরি ত্রুটি, দায়িত্বে অবহেলা এবং স্থাপনাটির নিয়মিত তদারকির অভাব ফুটে উঠেছে। অথচ, কারখানাটি এই অব্যবস্থাপনার মধ্যেও বছরে অন্তত একলাখ টন ডিএপি সার উৎপাদন করে আসছিল। দুর্ঘটনার পর তদন্তে দেখা যায়, প্লান্টটি এভাবে চলতে পারার কথা ছিল না। এর আধুনিক প্রায় সকল সিস্টেমই অচল হয়ে পড়েছিল। দুর্ঘটনাটি না ঘটলে হয়ত এভাবেই চলতে থাকত, আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনার আশঙ্কা ছিল। সে রাতের ঘটনাটিও ছোটখাট দুর্ঘটনা নয়। তবে ফায়ার সার্ভিস, প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট কারখানার লোকজনসহ সকল বিভাগ দ্রুততার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করায় বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অতিরিক্ত গ্যাস নিঃসরণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য যে তিনটি সিস্টেম ছিল তার সবই অচল। ট্যাঙ্কটিতে গ্যাস মাইনাস ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে রয়েছে একটি কনডেনসেট মেশিন, যা ২০০৭ সাল থেকে বিকল। গ্যাসের চাপ পরিমাপের জন্য বিশেষায়িত মিটারটিও ছিল অকেজো। গ্যাসের চাপ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও অকার্যকর। ট্যাঙ্ক থেকে বাড়তি গ্যাস নির্গত হলে তা বের করে দেয়ার জন্য যে সেফটি ভাল্ব রয়েছে সেটিও কাজ করেনি। অর্থাৎ অত্যাধুনিক যে প্রযুক্তিগুলো সংযোজিত রয়েছে তার সকল সিস্টেমই ফেল করেছে। কোন রকমে জোড়াতালি দিয়ে সনাতনী পদ্ধতিতে চলে আসছিল ডিএপি প্লান্টে। অথচ, এ প্রতিষ্ঠানটি সক্ষমতার সঙ্গে সার উৎপাদন করছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন ডিএপি সার। এজন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিয়মানুযায়ী বিসিআইসির পক্ষ থেকে পুরস্কৃতও হয়েছেন। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়ে স্পর্শকাতর এমন একটি প্লান্ট চালানো সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু দুর্ঘটনার পর যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তাতেই প্রমাণ হয় যে, এ ধরনের সার কারখানা বা কেমিক্যাল প্লান্ট ‘ছেলে খেলা’ কোন বিষয় নয়। গ্যাস ও কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করে এমন প্লান্টে কোন ত্রুটি দেখা দিলে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে যতদ্রুত সম্ভব ত্রুটিমুক্ত করতে হয়। কিন্তু ডিএপিতে নিয়মিত ওভারহোলিং ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম হয়নি বলে তদন্ত দলের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান। ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমল কান্তি বড়ুয়া ডিএপিতে যোগদান করেছেন নয়মাস আগে। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে আসা ১০ সদস্যের বিশেষজ্ঞ তদন্ত টিম শুক্রবারও কাজ করেছে। টিম সদস্যরা অকুস্থল ঘুরে দেখেন এবং সবগুলো সিস্টেম কার্যকর ছিল কিনা তা প্রত্যক্ষ করেন। কমিটির রিপোর্টের পর বোঝা যাবে কোন ধরনের ত্রুটির জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টসহ ১২ সদস্যের টিম প্লান্ট পরিদর্শন করবে। টিমের একটি অংশ ইতোমধ্যেই ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। শনিবার তারা ডিএপি প্লান্ট পরিদর্শন করে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করবেন। শুধু যন্ত্রপাতির ত্রুটিই নয়, প্লান্টের ওই বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার বিষয়টিও সামনে এসেছে। বিশেষ করে যে প্রকৌশলীরা গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর দায়িত্বে ছিলেন তারা নিয়মিত কর্মস্থলে যেতেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের কাজ পরিচালিত হতে হয় যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মকর্তাদের দিয়ে। তেমন কর্মকর্তা নিয়োগও দেয়া হয়। কিন্তু এ্যামোনিয়া ট্যাঙ্কে গ্যাস ভর্তি, চাপ পরীক্ষাসহ বিশেষায়িত কাজগুলো পরিচালিত হয়ে আসছিল সাধারণ অপারেটর দিয়ে। ঘটনা ঘটার সময় ছিল ২২ আগস্ট রাত ৯টা ৫০ মিনিটে। নিয়মানুযায়ী ১০টায় কর্মকর্তা ও কর্মীদের শিফট চেঞ্জ হয়। এ সময় একটি গ্রুপ প্রবেশ করে, আরেকটি গ্রুপ বেরিয়ে যায়। কর্মরতদের বেরিয়ে যাওয়া এবং আগতদের দায়িত্ব গ্রহণের মাঝামাঝি সময়টিতে কোন অনুপস্থিতির ঘটনা ছিল কিনা সেটিও তদন্ত টিম খতিয়ে দেখছে। তবে কারও গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু।
×