ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আরেক আরব বসন্তের পদধ্বনি!

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৪ আগস্ট ২০১৬

আরেক আরব বসন্তের পদধ্বনি!

আরব বিশ্বের তরুণ সমাজ বিক্ষুব্ধ। তারা রাগে ফুঁসছে। অসন্তোষের বহ্নি তাদের মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলছে। কারণ তারা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত। তাদের সামনে নিরানন্দ ভবিষ্যত। বেকারত্ব বাড়ছে। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে কিছু করার সুযোগও সঙ্কুচিত। চারদিকে সমস্যা ও অস্থিরতা। এমন পরিস্থিতিতে তরুণরা হাঁপিয়ে উঠেছে। তারা এ থেকে মুক্তি চায়। অথচ এই মুক্তির লক্ষ্যেই ২০১১ সালে শুরু হয়েছিল আরব বসন্ত। তরুণ কণ্ঠের বজ্রনির্ঘোষে মধ্যপ্রাচ্যের গোটা তল্লাট কেঁপে উঠেছিল। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে স্বৈরশাসকরা উৎখাত হয়েছিল। অন্য সরকারগুলোর ক্ষমতার ভিত কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা এক সময় তারুণ্যের সেই বিস্ফোরণ থেমে গেল। দপ করে জ্বলে উঠে যেন দপ করেই নিভে গেল। তারুণ্যের এই মহাজাগরণকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে লাগাতে ব্যর্থ হলো শাসকরা। হতাশার কালোছায়া সবাইকে গ্রাস করল। আরব তরুণদের অভ্যুত্থান কোথাও শক্তির জোরে ব্যর্থ করে দেয়া হলো। আবার কোথায়ও তার অধঃপতন ঘটে পর্যবসিত হলো রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে। এ অবস্থায় আরব তরুণদের অবস্থা আগে যা ছিল তার চেয়েও শোচনীয় আকার ধারণ করল। তাদের ওপর অধিকতর রাজনৈতিক দমন নির্যাতন নেমে এলো। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্য আয়ের দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। তেলের দর পতনের ফলে কিছু দেশের অর্থনীতি বাড়তি চাপের মুখে পড়েছে। অর্থনীতি ও রাজনীতির এই টালমাটাল অবস্থায় বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে গেছে। সন্ত্রাসবাদও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য সরকারের আত্মঘাতী নীতি এবং বিশেষ করে মিসরে আরও বেশি ক্ষতির কারণ ঘটাচ্ছে। অন্যত্র যেখানে বিশাল খুব জনশক্তিকে অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা হয় সেখানে আরব বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে তারা অভিশাপ হিসেবে বিবেচিত এবং সে কারণে তারা দমন-নির্যাতনের শিকার। এ অবস্থায় আরব যুব সমাজের সামনে তিনটি পথ খোলা থাকেÑ হয় স্বদেশে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, নয়ত বিদেশে পাড়ি জমানো এবং চরম ক্ষেত্রে জিহাদের পথ বেছে নেয়া। বস্তুতপক্ষে আজ সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে সবচেয়ে ভাল নেতার চাকরি হলো অস্ত্রধারী জিহাদীর চাকরি। আরব বিশ্বে শুধু তরুণ জনগোষ্ঠীরই নয়, সামগ্রিক জনসংখ্যারও বিস্ফোরণ ঘটেছে। ১৯৮০ সালের পর তিন দশকে এই অঞ্চলের জনসংখ্যা তিন গুণ বেড়ে ২০১০ সালে ৩৫ কোটি ৭০ লাখে দাঁড়ায়। বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ১ শতাংশ সেখানে আরব বিশ্বে ১.৮ শতাংশ। এই হিসাবে ২০২৫ সাল নাগাদ সেখানে আরও ১১ কোটি লোক যোগ হবে। ২০১০ সালে আরব জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশের বয়স ছিল ১৫ থেকে ২৪ বছর। তরুণ জনগোষ্ঠীর এই আনুপাতিক হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। দ্বিতীয় লক্ষণীয় দিক হলো তরুণদের বেকারত্ব। আরব বসন্তের আগে আরব যুবশক্তির ২৫ শতাংশ ছিল বেকার এবং সেটা বিশ্বের যে কোন অঞ্চলের চেয়ে বেশি। তারপর থেকে আরও বেড়েছে। এখন ৩০ শতাংশ হয়েছে। মিসরে ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের ৩৪ শতাংশ ছিল বেকার। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যেও বৈষম্য আছে। ওই সময় ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৬৫ শতাংশ মহিলা আর ওই বয়সী ৩৩ শতাংশ পুরুষ ছিল বেকার। এই বেকারত্ব ও আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার কারণে আরব যুবকরা দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে। ২০১৫ সালে বিদেশে বসবাসরত লোকদের মধ্যে আরব এবং বিশেষত সিরিয়া, মিসর ও ফিলিস্তিন যুবকদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তরুণ আরবরা বেশ অসুখী জীবনযাপন করছে। তারা নিজেদের যে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী থাকা সত্ত্বেও তারা ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার করছে। অনেকের ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে তারা দিনের বেলায় অন্যত্র চাকরি করছে আবার সংসারের বাড়তি প্রয়োজন মেটাতে সন্ধ্যার পর ট্যাক্সি চালাচ্ছে। শিক্ষিত যুবকদের কাছে চাকরি বিশেষত সরকারী চাকরি পাওয়া আজ সোনার হরিণের মতো। একটা চাকরি পাওয়ার জন্য তাদের কাউকে কাউকে এক দশক পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হয়। সামগ্রিকভাবে আরব বিশ্বে আজ চাকরির সঙ্কট। আর্থিক অনটনের মুখে সরকারী খাত কাটছাঁট করে ফেলা হয়েছে। নতুন সরকারী চাকরিও উধাও হয়ে গেছে। তেলের দরপতন আরব বিশ্বে চাকরির বাজার আরও সঙ্কুচিত করে ফেলেছে। তেলসমৃদ্ধ উপজাতীয় দেশগুলোতে আগে চাকরির বাজার অনেক প্রসারিত ছিল যার ফলে আশপাশের আরব দেশগুলোর শিক্ষিত যুবকরা সেখানে গিয়ে চাকরি জুটিয়ে নিত। এখন এই দেশগুলো নিজেদের লোককেই চাকরি দিতে পারছে তো ওদের দেবে কোত্থেকে। সৌদি আসবেন নিজেরই বছরে ২ লাখ ২৬ হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি করা প্রয়োজন। অথচ ২০১৫ সালে সে দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র ৪৯ হাজার। চাকরির পাশাপাশি যুব সমাজের গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা দলিত হচ্ছে। আরব বসন্তের পর থেকে যুদ্ধ ও টালমাটাল পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের ক্ষুধা চাপা পড়ে গেছে। মিসরে ইসলামপন্থী, উদারপন্থী, পেশাজীবী- সব ধরনের তরুণদের ভিন্নমত পোষণের জন্য কারাগারে পোড়া হচ্ছে। তিউনিসিয়া বাদে অন্যান্য দেশের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। গোটা আরব বিশ্বেই যুব সমাজের এখন অভিন্ন দাবি- গণতন্ত্র চাই, বেকারত্ব দূর কর, দুর্নীতি কমাও, নারী অধিকার প্রসারিত কর, পুলিশী নিষ্ঠুরতা বন্ধ কর। ২০১১ সালের আরব বসন্তের তরুণ সমাজের মধ্যে পরিবর্তনের সুতীব্র আকাক্সক্ষা দেখা দিয়েছিল। নানা কারণে সেই আকাক্সক্ষার অপমৃত্যু ঘটলেও এখন নতুন করে দেখা দিতে শুরু করেছে। কতদিন তাদের দামিয়ে রাখা যাবে? যে বিশ্বে গণতন্ত্র নেই, চাকরি পরিণত হয়েছে সোনার হরিণে, যেখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থাই তরুণ সমাজকে ব্রাত্যজনে পরিণত করেছে সেখানে এক সময় না এক সময় ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠবেই। আজ বাগদাদ থেকে রাবাত পর্যন্ত তরুণদের বিভিন্ন দাবিতে ছোটখাটো যেসব বিক্ষোভ ঘটছে তা ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও আরব বসন্তের দ্বিতীয় তরঙ্গে ইঙ্গিত বহন করে। তরুণ সমাজের সমস্যার প্রতি শাসক গোষ্ঠীগুলোর নির্লিপ্ততা এবং সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতাই পরবর্তী বিস্ফোরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×