ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষা-শরত মিতালি

ঋতুবৈচিত্র্যে মেঘদূতের খেলা- শরতের আগমনী বার্তা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৬ আগস্ট ২০১৬

ঋতুবৈচিত্র্যে মেঘদূতের খেলা- শরতের আগমনী বার্তা

সমুদ্র হক ॥ ঋতুবৈচিত্র্যে এখন মেঘ বৃষ্টির ধারাপাত। আকাশে মেঘদূতের অবাধ আনাগোনা। দেখে মনে হবে বেলা শেষের প্রান্তরে বর্ষা আর শরত মিতালি করেছে। শরতের আগমনী বারতায় এবারের শ্রাবণের শেষ মুহূর্তের মেঘমঞ্জরি বৃষ্টির ক্লাসিক্যাল সুরকে সঙ্গে নিয়ে শরতকে স্বাগত জানাতে বরণ ডালা সাজিয়েছে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ঢেউ বঙ্গোপসাগরে নাচন তুলেছে তারই রেশ গিয়ে পড়েছে ঋতুর পালাবদলে। ‘আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনের’ সুর মালা শরতের গলে পরাতে এগিয়ে এসেছে। দুই ঋতুর মধুর মিতালির এমন ছন্দ ধরাধামে লুকোচুরি খেলছে। যেখানে উদাসী মেঘলা মন ভেসে বেড়াচ্ছে সুদূর নীলিমায়। যুগে যুগে শিল্পী কবি সাহিত্যিক মানব মনের হৃদয়নাভূতিকে মেঘের জলধারায় বৃষ্টিতে সঞ্চারিত করেছেন। যেখানে কখনও সখনও কোন ভাললাগাও বিরহ কাতর যন্ত্রনায় বুক ভারি করে তোলে। ভালবাসার গভীরে তলিয়ে যেতে থাকে। এমনই ধারায় শিল্প সাহিত্য ও সঙ্গীতে বর্ষা ও শরত পেয়েছে ধ্রুপদ লয়ের চিরন্তন মর্যাদা। এমন মৃদু সুরের ব্যাঞ্জনার ঋতু মহানগরী রাজধানী ঢাকায় কংক্রিটের বনে চোখে পড়ে না, মানুষের শোরগোলে সেই সুর কানেও বাজে না। এই সময়টায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে চোখে পড়বে: কেবলই নেমে যাওয়া বর্ষার জল জমিতে থিতু হয়ে আছে। যেখানে প্রতিচ্ছায়া পড়েছে নীল আকাশের সাদা মেঘের ভেলা। তারই ধারে কোন ছোট বিলে গাঁয়ের লোক গিয়ে টানা জাল ফেলেছে। তার কিছু বিলে বাঁশ এঁটে খেয়াজাল ফেলেছে বর্ষার মাঝিরা। ছোট ও মাঝারি মাছগুলো লাফিয়ে উঠছে সেই টানা ও খেয়াজালে। শরতের শুরুতে জলে ভিজে যাওয়া জমিগুলোতে চারা রোপণ করবে কৃষক। এমনই নিসর্গে গোধূলি বেলায় মনে করে দেয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা ‘গোধূলি লগনে মেঘে ঢেকে ছিল তারা/আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সাড়া/ হয়ত সে তুমি শোন নাই/সহজে বিদায় দিলে তাই/আকাশ মুখর ছিল যে তখন ঝরঝর বারিধারায়...।’ এই পঙতি প্রকৃতির নিসর্গের ভাষায় বলে: শ্রাবণের শেষের বেলায় বর্ষার যে কথা তা বলে দিয়েছে। শরত হয়ত তা শোনেনি তাই সহজে বিদায় দিয়েছে। তখন আকাশ মুখর ছিল বারিধারায়। বাংলার ষড় ঋতুর বৈচিত্র্যে অনেকটা সময়জুড়ে থাকে মেঘ বৃষ্টি। তপ্ত দিনের রৌদ্রছায়ার মধ্যেই হঠাৎ বৃষ্টি অধিকার প্রতিষ্ঠায় উত্তরে ঘন কালো মেঘ জড়ো করে। বর্ষা ও শরতে সকল ধরনের মেঘ আকাশের দখল নিয়ে নেয়। মনে হবে মেঘদের সম্মেলন হচ্ছে। শুধু মেঘ আর মেঘ। কেউ ধূমল, কেউ গৈরিক, কেউ ফুরফুরে পেঁজা পেঁজা। তাদের কত নাম। কাদাম্বনী, জলদ, জলধর, সেক্তা, ধূমল, অভ্র। এদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে মেঘপুষ্প (বৃষ্টি), মেঘাগম (বর্ষা), মেঘ বহ্নি (বিজলী), মেঘাত্যয় (শরত), মেঘ ভাঙ্গা (রোদ), মেঘ যামিনী, মেঘনীল, মেঘসখা.... আরও কত মেঘ। মেঘেদের এত ক্ষমতা যে, ইচ্ছে হলেই দিনে সূর্য মামা রাতে চাঁদ মামাকে ঢেকে দেয়। এমন মেঘলা দিনগুলোতে মানব মনও উদাসী হয়ে ওঠে। মেঘের সঙ্গে মানুষের মনের তুলনা করা হয়। মেঘের মতোই মানুষের মনও কত বিচিত্র। কখন যে চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল চিকচিক করে ওঠে...। মানব মনের অনেক কিছুই মেঘ ও বৃষ্টিকে ঘিরে হৃদয় মনে আলো আঁধারের খেলা খেলে। কখনও মনে হয় যাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসবে সেখানে কি কোন কালো মেঘের আঁধার লুকিয়ে আছে! সবই মেঘের খেলা। নীল আকাশে মেঘের ভেলা। প্রকৃতির মধ্যেই মানব হৃদয়ের সেতুবন্ধন রচিত হয়ে ওঠে। যা প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্য! ভাবের উপলব্ধি ও মধুময় প্রণয়ের বৈচিত্র্যে সুর হয়ে বাজে- ‘মন মোর মেঘের সঙ্গি উড়ে চলে দিগদিগন্তে... তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা...।’ ঋতু বৈচিত্র্যে এবার তেমনই সুর বেজে উঠেছে প্রকৃতিতে। উত্তরের নদীগুলো ফুলে ফেঁপে উঠে কিছুটা ভাসিয়ে দিয়ে উজানের ঢল ছুটে চলেছে মধ্যাঞ্চল থেকে দক্ষিণের দিকে। পাহাড়ী ঢলের পানি মাগুরার মহম্মদপুরের মধুমতি নদীর পানি উছলে তুলেছে। বর্ষার আগেই গোপালনগর থেকে পারলা পর্যন্ত মধুমতি নদীর মাঝ বরাবর জেলে ওঠে বিশাল চর। তা এখন জলে ভরে গেছে। কাশিপুর রায়পুর রুইজানি ভোলানাথপুর গ্রাম ভাঙনের মুখে পড়েছে। উত্তরের যমুনা উছলে ওঠার পর ক্ষান্ত দিয়ে মধুমতিকে ভরিয়ে দিয়েছে। মেঘের পরে মেঘ জমে ঋতু কতই না খেলা খেলছে। এই তো শরতের কাশবনের ফুল ফোটা শুরু হয়ে গেল বলে...।
×