ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ছিটের আমি, সেই আমি নই’

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১ আগস্ট ২০১৬

‘ছিটের আমি,  সেই আমি  নই’

তাহমিন হক ববী, বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে ফিরে ॥ নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ২৮ নম্বর বড়খানকি খারিজা বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ময়মনা বেওয়া। তিনি জানালেন, আগে তিনি ছিটমহলের বাসিন্দা ছিলেন। তবে এখন আর ছিটমহলের বাসিন্দা নন তিনি। তিনি বলেন, আমি সেই আমি নই। আমি এখন বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। ময়মনা জানান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে তার দুঃখ দুর্দশা দূর হয়েছে। ৬৮ বছরের বন্দী জীবন অবসানের একটি বছর অতিবাহিত হলো। এই এক বছরে তিনি সরকারের অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। তাই শেষ বয়সে এই বৃদ্ধা যেন নতুন করে মনোবল ফিরে পেয়েছেন। সেই মনোবলে নিজেই জানালেন তার বয়স ১২১ বছর চলছে। জীবনের শেষ প্রান্তে দুটি লাঠির ওপর ভর করে চলাচল করেন তিনি। বৃদ্ধা জানালেন তার জীবনের শেষ ইচ্ছা, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনে থেকে দেখার ময়মনা বলেন, শেখের বেটি হাসিনা হামাক ছিটমহলের ৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করিছে। মুই (আমি) প্রধানমন্ত্রীকে দুই চোখ দিয়া প্রাণ ভরি দেখিবার চাও। মোর ম্যালা (অনেক) দিনের শখ। মোর বয়স হইছে ১২১ বছর। আর কতদিন বাঁচিম। মরণের আগত শেখের বেটির দুই নয়ন ভরি দেখিলে মোর জীবনের শ্যাষ আশা পূরণ হইবে। ছিটমহল বিলুপ্ত হবার পর তিনি পেয়েছেন বয়স্ক ভাতার কার্ড। এতে তিনি প্রতি তিন মাস অন্তর ১২০০ করে টাকাও পাচ্ছেন। এ ছাড়া পেয়ে চলেছেন ভিজিএফের চাল। এ ছাড়া সরকারের পক্ষে বাড়িতে পেয়েছেন নলকূপ, স্যানিটেশন ল্যাট্রিন ও বিনামূল্যে বিদ্যুত সংযোগ। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বামী বাবর আলী দেওয়ান মারা যান। ১৪ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। ৭ ছেলে ও ৭ মেয়ের জননী তিনি। এর মধ্যে ২ ছেলে ও ৪ মেয়ে মারা গেছে। বেঁচে আছে ৫ ছেলে ৩ মেয়ে। নাতি-নাতনি ৪৫ জন। পুতি ৬ জন। দুই পুতির বিয়ে হয়েছে। সেই দুই পুতির ঘরে দুই সন্তানও এসেছে। বৃদ্ধার বড় ছেলে লাল মামুদ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি এখন পরিবার পরিজন নিয়ে ডিমলা উপজেলার গয়াবাড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম খড়িবাড়ীর পূর্বপাড়া গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মায়ের নির্দেশে অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পেয়েছি। লাল মামুদ জানালেন, সবার মাথার ছায়া হয়ে বেঁচে আছেন মা ময়মনা বেওয়া। যার নির্দেশে এখনও চলে পুরো পরিবার। লাল মামুদ জানান, তার মার ইচ্ছে থাকার পরও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারেননি তিনি। কারণ ছিটমহলে ছিল না স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা। বৃদ্ধা ময়মনা এখনও স্বামীর ভিটায় বাস করেন। মেজ ছেলের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৫৫), দুই নাতি জিন্নু ও আবুল হোসেনসহ ৯ সদস্যের পরিবারে তার বাস। স্বামীর কবর বিলুপ্ত ছিটমহলের ভেতরে থাকায় স্বামীর ভিটা ছাড়েননি তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই বৃদ্ধা ১২১ বছর বয়সে আজ বিলুপ্ত ছিটমহলের এক জীবন্ত ইতিহাস বৈ কি!
×