ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ম্যাকাব্রে ॥ মানবমুক্তির এক শৈল্পিক অভিব্যক্তি

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৮ জুলাই ২০১৬

ম্যাকাব্রে ॥ মানবমুক্তির এক শৈল্পিক অভিব্যক্তি

বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের বিশ্ব। এই বিশ্ব রাজনৈতিক হানাহানি, রক্ত আর মৃত্যুর বিশ্ব। আমাদের কাছে অপরিচিত লাগে কিছু মানুষকে। চলছে তাদের উদ্দাম নৃত্য। এ নৃত্য অন্ধকারের নৃত্য। এ নৃত্য মৃত্যুর নৃত্য। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের নাটক ম্যাকাব্রে আমাদের নিয়ে যায় এই অপরিচিত, অথচ ল্ডমশই পরিচিত হয়ে ওঠা জগতটির ভেতরে। এই জগতে যেমন রয়েছে মুখোশের আড়ালের চরিত্র, তেমনি রয়েছে অস্তিত্বহীন মানুষের অস্তিত্ব অর্জনের সংগ্রাম। রয়েছে মুক্তির জন্য মানবসত্তার আকুল আকাক্সক্ষা। ম্যাকাব্রে শব্দটি সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে এটি একটি আর্ট ফর্মকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে। এই ফর্মটি হচ্ছে একটি রূপক নৃত্য। এই নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় সদা বিরাজমান মৃত্যুর সর্বজনীন ক্ষমতাকে। ম্যাকাব্রে নাটকটিতেও দেখা যায় মৃত্যুর এই সর্বগ্রাসী নৃত্য। নাটকটি শুরু হওয়ার আগে দর্শকরা মিলনায়তনে প্রবেশ করেই দেখতে পান এক শান্তশিষ্ট বৃদ্ধের আকুল বেহালাবাদন। তিনি আইনস্টাইন। আপেক্ষিক তত্ত্বের আলোকে দেখছেন এই বিশ্ব, সমাজ, মানুষ ও তার সামনের দর্শকদের। যেন তার অভিজ্ঞ চোখে তিনি দেখে নিচ্ছেন আমাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অন্য আরেক চরিত্রকে। তার বেহালাবাদন শেষ হতেই শুরু হয়ে যায় নাটক। নেপথ্য থেকে এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘লাশটা কোথায় পাওয়া গিয়েছে? কে পেয়েছে ওটা?’ এই কথাগুলো বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে অতিপরিচিত এবং সমকালীন। তবে এই কথাগুলো এখানেই আটকে থাকে না। আরও কিছুদূর এগিয়ে চলে এবং লাশের পোস্টমর্টেম করে তবেই ছাড়ে। সেই সঙ্গে পোস্টমর্টেম হয়ে যায় আমাদের ভেতরের মানসিক জগতটিও। এরপরে নাটকটি এগিয়ে যেতে থাকে দুর্দান্ত গতিতে। এই নাটকটি একজন কয়েদির ভ্রমণ কাহিনী; এটি এমন একটি ভ্রমণ যেটির গন্তব্য মৃত্যু। নাটকটির পরিবেশনার ভেতরে কখনও এসে পড়ে দেশীয় রাজনীতি, কখনও বা বিশ্বরাজনীতির কূটকৌশল। সেইসঙ্গে অবধারিতভাবে এসে পড়ে বিশ্ব মোড়লের যুদ্ধ নিয়ে আত্মঅহমিকা। আমরা দেখতে পাই নিষ্ঠুরতা ও বঞ্চনার একটি জগত। এই জগতের ব্যবচ্ছেদ চলে এক শক্তিশালী উত্তর-আধুনিক নাট্যল্ডিয়ার মাধ্যমে। এই নাটকটি লিখেছেন তরুণ নাট্যকার আনিকা মাহিন। নাটকটিতে সমকালীন প্রসঙ্গ তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। তার মতে, ‘এই নাটকটি একটি অভিব্যক্তি, একটি সত্তার মুক্তির আকাক্সক্ষার অভিব্যক্তি। একটি সত্তার ভ্রমণ, অনস্তিত্ব অভিমুখে।’ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন অভিজ্ঞ নাট্যনির্দেশক কামালউদ্দিন নীলু। তিনি আমাদের দেশে তো বটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যতিল্ডমী নাট্যনির্দেশনার জন্য সুপরিচিত। তিনি এই নাটকে ব্যবহার করেছেন বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি, বিশেষ করে ভিডিওগ্রাফি, প্রোজেকশন টেকনোলজি, এ্যানিমেশন, ত্রিমাত্রিক প্রোজেকশন ম্যাপিং, স্থাপনা শিল্প এবং সেইসঙ্গে পূর্ব-পশ্চিমের লিভিং আর্ট। নাটকটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভৌগোলিক সীমারেখার উর্ধে অবস্থানের মাধ্যমে এটি ধারণ করে মুক্তিকেÑ এটি প্রকাশ করে জাতিগোষ্ঠী ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল মানুষই এক, এবং প্রত্যেকেরই সম্মানের সঙ্গে জীবনধারণের অধিকার রয়েছে। এই পারফর্মেন্সটির মূল বিষয় হলো মৃত্যুর অনুপ্রবেশ, যেটি ডিস্টোপিয়ার একটি অংশ, যেখানকার সমাজব্যবস্থা মানুষের দুর্দশা, যন্ত্রণা, নিপীড়ন, ব্যাধি এবং নোংরা পরিবেশে একসঙ্গে অনেক মানুষের থাকাকে নির্দেশ করে।’ সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের ম্যাকাব্রে নাটকটি অন্তঃসাংস্কৃতিক এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক থিয়েটার পরিবেশনার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করে। এটি আমাদের সমকালীন বৈশ্বিক সময় ও কালের ভেতরে একটি পরিপূর্ণ শৈল্পিক অভিব্যক্তিকেও সৃষ্টি করে। এই নাটকটি মানুষের বন্দীদশার একটি চিত্র। এটি উদ্ঘাটন করে দেয় মানুষের শরীর ও মনস্তত্ত্বের ওপরে অদৃশ্য ও অপ্রকাশিত শক্তির আধিপত্যকে। এই নাটকটির শব্দ, ভিডিও এবং প্রোজেকশন ডিজাইন করেছেন আহসান রেজা খান। আলোক পরিকল্পনা করেছেন নাসিরুল হক খোকন এবং নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন সেতু আজাদ, মেহমুদ সিদ্দিকী, শিপ্রা দাস, মেজবাউল করিম, বাপ্পি আমিন, মর্জিনা মুনা, চন্দ্র বর্মণ, শুভঙ্কর দাস ও সাজু সাজেদ।-
×