ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতি সমিতির ৮ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১ জুন ২০১৬

অর্থনীতি সমিতির ৮ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বিকল্প বাজেট

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আগামী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ৮ লাখ ৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকার ‘বিকল্প বাজেট’ প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ)। কর আরোপের যোগ্য সেবা খাতের পরিধি বাড়িয়ে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ছয় লাখ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। অর্থনীতি সমিতির মতে, প্রায় চার গুণ বাড়িয়ে মোট বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৮০ শতাংশের যোগান দেবে এই রাজস্ব আয়। বাকি ২০ শতাংশ পূরণ ঘাটতি অর্থায়নে সরকারী-বেসরকারী যৌথ অংশীদারিত্ব (পিপিপি), বিদেশে বসবাসকারী দেশীয় নাগরিকদের বন্ড, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ঋণ থেকে যোগান দেয়া হবে। এই বিকল্প বাজেট-প্রস্তাবটিকে ‘রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক দলিল’ উল্লেখ করে সংগঠনটি বলছে, মৌলিক রূপান্তরমুখী এ দলিল বাস্তবায়নে প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও দৃঢ় অঙ্গীকার। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে এমন একটি বাজেটই দরকার বলেও মনে করছে তারা। মঙ্গলবার রাজধানীর ইস্কাটনে নিজস্ব অডিটরিয়ামে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবনা তুলে ধরেন সংগঠনের সাবেক সভাপতি ড. আবুল বারকাত। এ সময় সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ ও অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বাজেট প্রস্তাবনায় তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রায় ৪ গুণ অর্থাৎ ৮ লাখ ৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। সরকারের রাজস্ব আয় থেকে আসবে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৮০ শতাংশের যোগান দেবে রাজস্ব আয়। আর বাজেটের বাকি ২০ শতাংশ অর্থাৎ ঘাটতি অর্থায়নে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা যোগান দেবে পিপিপি, বিদেশী নাগরিকদের বন্ড, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক ঋণ থেকে। বাজেট প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় আবুল বারকাত বলেন, আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটের আয় কাঠামোতে বিত্তশালী ও ধনীদের ওপর করের বোঝা অতীতের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পাবে যা সমাজে ধন-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য ও ক্রমবর্ধমান অসমতা হ্রাস করবে। এছাড়া প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে দ্রুত ভিত্তিতে বৈষম্য হ্রাসকরণ, ভূমি-কৃষি-জলা সংস্কার, মানবসম্পদ দ্রুত বিকশিত করা, শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করা, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগসহ আত্মকর্মসংস্থান বিকশিত করা, বিজ্ঞা-প্রযুক্তি সর্বোচ্চ ব্যবহার, নারীর ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমগ্র প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বাজেট প্রস্তাবের পিছনে যে দর্শন কাজ করেছে তা হলো, বৈষম্যহীন, উন্নত শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়া। তবে এর জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা শক্তিশালী হতে হবে। উন্নত বিশ্বে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আয় থেকেই বাজেটের সিংহভাগ আসে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল হতে পারে না। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী সব ধরনের সামাজিক অধিকার বাস্তবায়নও আমাদের বাজেটের দর্শন। এছাড়া রাজস্ব আয় বাড়াতে কালো টাকা বের করে আনা, যারা কর দেয় না এমন ধনীদের করের আওতায় আনা ও রাজস্ব বোর্ডের চুরি ঠেকানোর পরামর্শ দেন তিনি। এ বাজেট বাস্তবায়নে একটি কাজ করতে হবে তা হলো রেন্ট সিকার দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সরকার ও রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে। বাজেট আয় ॥ প্রস্তাবিত বিকল্প রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বাজেটে মোট আয় ধরা হয়েছে ৮০ শতাংশ, যা অর্থের অঙ্কে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। বাকি ২০ শতাংশ অর্থাৎ ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা হবে ঘটতি বাজেট। আয়ের ৮০ শতাংশের মধ্যে ৭৪.৯২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এছাড়া নন-এনবিআর থেকে ২৯.৭৭ শতাংশ, নন-ট্যাক্স রেভিনিউ ২৮ দশমিক ২১ শতাংশ। আর ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা, সঞ্চচয়পত্র থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা, পিপিপি ইক্যুইটি থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা এবং প্রবাসী বন্ড থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেয়ার প্রস্তাব করেছে সমিতি। এছাড়া বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে মোট ১৩টি নতুন উৎস নিদের্শ করেছি যা অতিতে ছিল না। সরকারী আয় বৃদ্ধির নতুন এসব উৎসের মধ্যে থাকবে বিদেশী নাগরিকদের উপর কর, সেবা থেকে প্রাপ্তি কর, সম্পদ কর, বিমান পরিবহন ও ভ্রমণ কর, তার ও টেলিফোন বোর্ড, টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশন, সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিআইডাব্লিউটিএ, সরকারী স্টেশনারী বিক্রয় এবং পৌর হোল্ডিং কর। নতুন এসব উৎস থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হতে পারে ৪৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যা মোট রাজস্ব আয়ের ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে সম্পদ কর থেকেই সরকার ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারে। বাজেট ব্যয় ॥ অপরদিকে ব্যয় চিত্রে দেখা যায়, বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ কাঠামোতে গুণগত রূপান্তর ঘটবে। মোট বরাদ্দ ও আনুপাতিক বরাদ্দে উন্নয়ন বাজেট হবে অনুন্নয়ন বাজেটের চেয়ে অনেক বেশি যা এখন ঠিক উল্টো। এখন উন্নয়ন : অনুন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের অনুপাত ৩৫ : ৬৫, যা আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে হবে ৭২ : ২৮। উন্নয়ন বরাদ্দ এখনকার তুলনায় প্রায় ৬ গুণ বাড়িয়ে ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭১ কোটি টাকায় উন্নিত হবে, আর অনুন্নয়ন বরাদ্দ এখনকার তুলনায় ১ দশমিক ২ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ২২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা উন্নিত হবে। এর মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে শিক্ষা খাত, এ খাতে আগামী বাজেটের জন্য ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছি। যা চলমান বাজেটের ৩ দশমিক ৭৪ গুণ বেশি। স্বাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারী বরাদ্দ ১২ হাজার ৬৯৫ কাটি টাকা। আমরা এ বরাদ্দ ৪ গুণ বৃদ্ধি করে ৫১ হাজার কাটি টাকায় উন্নিত করার প্রস্তাব করেছি। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে সরকারী বরাদ্দ ১৬ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৫৭ হাজার ১ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে এখন ১৮ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ ৮ দশমিক ৩৭ গুণ বাড়িয়ে ১ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বর্তমান বরাদ্দ ২৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা তা ৪ দশমিক ৬০ গুণ বাড়িয়ে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৪১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।
×