ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলাপচারিতায় সংস্কৃতিমন্ত্রী

বৈশাখ বাঙালী মননে উদার সংস্কৃতি চর্চার জাগরণ সৃষ্টি করে

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৪ এপ্রিল ২০১৬

বৈশাখ বাঙালী মননে উদার সংস্কৃতি চর্চার জাগরণ সৃষ্টি করে

মোরসালিন মিজান ॥ মামুলী বর্ষবরণ নয়, বাঙালীর সহস্র বছরের সংস্কৃতির সমৃদ্ধ যে রূপ, আজ পহেলা বৈশাখে তা ফুটে উঠবে। বহুমাত্রিক আয়োজনে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নেবে বাংলাদেশ। গ্রাম শহরের বাছ বিচার নেই। সর্বত্রই মহা আনন্দের উপলক্ষ। সঙ্গত কারণে ব্যস্ত সংস্কৃতিমন্ত্রী ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। দেশব্যাপী নানা আয়োজনে সহায়তা দান ও খোঁজখবর নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে কেমন প্রস্তুতি? কতটা জাগরণ আশা করেন? এমন আরও প্রশ্ন ছিল মন্ত্রীর কাছে। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সেসব প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। আশ্বস্ত করেন। মন্ত্রীর মতে, এই জাগরণ একদিনের হলে চলবে না। কেবল আনুষ্ঠানিকতাও কাম্য নয়। বৈশাখের জাগরণ ধরে রাখার ওপর জোর দেন তিনি। বলেন, পরিপূর্ণ প্রাপ্তির আশা করলে সকলকে সারা বছর কাজ করতে হবে। আর তা হলে পুলিশের পাহাড়া প্রয়োজন হবে না। বৈশাখী উৎসবের জন্য সময় বেধে দেয়ার বিপরীতে নিজের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তিনি। বাঙালীকে সাহস নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার আহ্বান জানান। আর তাহলে বাংলাদেশের সংবিধানের মৌল চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীও লেজ গুটিয়ে পালাবে বলে মনে করেন তিনি। বুধবার মন্ত্রীর সচিবালয়ের অফিসকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, এখানেও নানা চেহারায় উঁকি দিচ্ছে বৈশাখ। মিষ্টি মুড়ি মুড়কি নারিকেলের নাড়ু ইত্যাদি দিয়ে সাজানো চমৎকার সব প্যাকেট। কিছু মৃৎপাত্র, কারুশিল্পের নানা নিদর্শন। বাংলা নববর্ষের উপহার হয়ে এগুলো বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠানো হচ্ছে। মন্ত্রীর কাছেও আসছে দারুণ সব উপহার। দু’-একটি খুলে তিনি চমৎকার হাসিটা হাসলেন। বললেন, বেশ লাগে কিন্তু! বাঙালীর উদ্যাপন এমনই হওয়া উচিত। নববর্ষে নিজের শৈশবের স্মৃতি হাতড়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা তো আমাদের নিজেদের কৃষ্টি নিয়ে ছিলাম। ছোট বেলায় পান্তা খেয়েছি। সঙ্গে ছিল শুটকি ভর্তা বা এরকম কিছু। মিষ্টি খেয়েছি। নাড়ু ইত্যাদি দিয়ে নববর্ষ দিব্যি কেটেছে। এখন কেন কাটবে না? বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতার মূলে গিয়ে মন্ত্রী বলেন, পহেলা বৈশাখ বঙালীর সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ সমান উৎসাহ নিয়ে বর্ষবরণ উৎসবে যোগ দেন। গোটা দেশ এই আয়োজনের সঙ্গে একাত্ম। প্রতিটি অনুষ্ঠান থেকে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের স্বরূপ তুলে ধরা হয়। বছরের প্রথম দিনে এমন শেকড় খুঁজে ফেরা, অন্যের আচার ভুলে নিজের উদার সংস্কৃতির চর্চা সত্যি গর্ব করার মতো বিষয়। এভাবে এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয়। বৈশাখের এখানেই প্রধান গুরুত্ব। সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, বৈশাখে দেশজুড়ে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এগুলো মানুষের ভেতরের যে আনন্দ, যে চেতনা তার বহির্প্রকাশ। বাঙালী চেতনার আশ্চর্য জাগরণ ঘটে বৈশাখে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তবে জরুরী আলোচনার সূত্রপাত করে মন্ত্রী বলেন, আমরা প্রায়ই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী থেকে যাচ্ছি। কেবল আনুষ্ঠানিকতা কিন্তু কাম্য নয়। পরিপূর্ণ প্রাপ্তির আশা করলে সকলকে সারা বছর নিজের কৃষ্টির প্রতি অনুগত থেকে কাজ করতে হবে। বাঙালীর তাতেই মুক্তি। দূরদর্শী চিন্তার কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমাদের সন্তানেরা যেখানে বড় হয়ে উঠছে, তারা বড় হচ্ছে কোথায়? পারিবারিক পরিবেশে বড় হচ্ছে। আর বেড়ে উঠছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। যদি এই দুটি জায়গায় তাদের বাঙালী হওয়ার শিক্ষা না দেই তাহলে তো হবে না। এরা আত্মবিস্মৃত মানুষে পরিণত হবে। ১৯৭১ সালে আমরা তো আত্মপরিচয়হীন অবস্থা থেকেই নিজেদের আবিষ্কার করেছিলাম। তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কেন পিছিয়ে থাকবে? সমস্যার সমাধানে শিক্ষা ও সংস্কৃতির একটা সমন্বয় ঘটানোর পরামর্শ দেন তিনি। এবারই প্রথম বর্ষবরণ উৎসব উদ্যাপনে বিশেষ ভাতা প্রদান করেছে সরকার। যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে উৎসবটি আরও বেশি জনগণের হয়েছে। এ আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী বলেন, বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালীর কিছু প্রস্তুতির দরকার হয়। সরকারের দেয়া ভাতা তাদের এ ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। মন্ত্রী বলেন, ভাতা প্রদানের মধ্য দিয়ে সরকার মূলত বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে জোরালো অবস্থানটি পুনর্ব্যক্ত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে যেসব সূক্ষ্মবোধ বুদ্ধি নিয়ে সরকার কাজ করছে, বৈশাখী ভাতা তার একটি। এর ফলে এবার আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে সারাদেশে মহাসমারোহে উদযাপিত হবে বৈশাখ। বাংলার প্রতি প্রান্তে থাকবে লোকজ আচার অনুষ্ঠান। আমরা সে অনুকূল পরিবেশ বজায় রেখেছি। যত রকমের সহায়তা প্রয়োজন নিশ্চিত করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকিও বেশ কানে আসছে। সরকার কি একটু নমনীয়? এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, এই দেশ মৌলবাদীদের নয়। ধর্মীয় উগ্রবাদের কোন স্থান এ দেশে হবে না। যেসব হুঙ্কার কখনও সখনও আসে, বাঙালী গ্রাহ্য করে না। ঘরে বসে থাকে না। বরং সব ধরনের ভয়কে জয় করে চলাই বাঙালীর স্বভাব। ওলামা লীগ এমনকি পহেলা বৈশাখে উৎসব বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছে। সাম্প্রতিক এই আস্ফালন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ওই যে, ওলামা লীগ না কি একটা, ওটার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক নেই। এই কথা ইতোমেধ্য বলে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের কথা যারা বলে তাদের বাংলাদেশে কোন স্থান হতে পারে না। তিনি যোগ করেন, মৌলবাদীদের জঙ্গী কর্মকা- আমাদের সংবিধানের মূল চেতনার বিরোধী। তারা সরকারের চেতনার বিরুদ্ধে কথা বলছে না শুধু, রাষ্ট্রীয় চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এদের তো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে পারার কথা নয়। ভুঁইফোর মনে হলেও ভবিষ্যতে এরা বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব গোষ্ঠীকে কোন ধরনের সমাবেশ করতে না দেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। একই সঙ্গে সংস্কৃতিকর্মীদের আরও বেশি করে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বলেন, আমাদের বোনেরা-মায়েরা নিগৃহীত হবে, আমাদের কিছুই করার থাকবে না? এই যে গত বছর নববর্ষে দুঃখজনক ঘটনা ঘটল, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি কর্মীদের কিছুই করার ছিল না? পুলিশের পক্ষ থেকে বর্ষবরণ উৎসবের সময় বেঁধে দেয়া প্রসঙ্গেও কথা বলেন মন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাজ করবে। কিন্তু এমন একটি আনন্দঘন মুহূর্তে বার বার আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ সামনে আনার প্রয়োজন দেখি না। এতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন কিছু বলা উচিত নয় যাতে করে জনমনে ভীতির সঞ্চার হয়। মানুষ যেন তাদের কথা শুনে গৃহবন্দী না হয়ে যায়। মৌলবাদীরা তো এই চাইছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, বৈশাখের সব অনুষ্ঠান পাঁচটায় শেষ করতে হবে, সাতটায় শেষ করতে হবে, কেন? ঢাকায় রাতভর কত অনুষ্ঠান হচ্ছে না? গ্রামে গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে না? নিরাপত্তা তো পুলিশ দিচ্ছে। বৈশাখে কেন পারবে না? জনগণকেও নিজেদের মতো করে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, আমাদের পুলিশের সংখ্যা কত? আমি কি শুধু শহর নিয়ে ভাবব? জেলা- উপজেলায় কতজনকে নিরাপত্তা দেবে পুলিশ? বাঙালীকে নিজ সাহসেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার ব্যাপারেও আগে থেকে সরব ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এটি খেতে তো কোন বাধা নেই। কথা হচ্ছে, পান্তা ইলিশ বাঙালীর বর্ষবরণের সঙ্গে কোনভাবেই সম্পৃক্ত নয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন ও আচার আমরা পহেলা বৈশাখে অনুসরণ করার চেষ্টা করি, সেখানে ইলিশ অনুপস্থিত। শহুরে কিছু মানুষ পান্তা ইলিশ চালু করেছিলেন। এটা আসলে বিলাসীতা। হাজার হাজার টাকায় একদল ইলিশ কিনে খাবে। সাধারণ মানুষ চেয়ে দেখবে। এটা তো হয় না। সবচেয়ে বড় কথা, এখন ইলিশের প্রজনন মৌসুম। এখন খেলে সারা বছর খাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। এ কারণেই এবার ইলিশ খাওয়া নিয়ে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। বীভৎস শব্দ দূষণের কারণে ভুবুজেলা নামের বাঁশিটি বন্ধের জোর দাবি উঠেছে। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এটিও আমাদের বর্ষবরণের কোন অনুষঙ্গ নয়। অন্যের সংস্কৃতি। এই বাঁশি বাজিয়ে কেউ যেন পরিবেশ নষ্ট না করতে পারে সেদিকে নজড় রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলা হয়েছে। নিজের সংস্কৃতির শক্তিতে বলিয়ান বাঙালী বৈশাখ থেকে শক্তি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে সব সময় থাকা আসাদুজামান নূর।
×