ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আনসারুল্লাহ

রাজধানীতে আরও দুই জঙ্গী আস্তানার সন্ধান, বিস্ফোরক উদ্ধার

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রাজধানীতে আরও দুই জঙ্গী আস্তানার সন্ধান, বিস্ফোরক উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে আরও দুটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পেয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। এ নিয়ে গত দু’দিনে মোট চারটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলল। যদিও নতুন করে সন্ধান পাওয়া আস্তানা দুটি সম্পর্কে নিরাপত্তার কারণে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। তবে জঙ্গী আস্তানা দুটি থেকে বিপুল পরিমাণ জিহাদী বইপত্রসহ নানা আলামত উদ্ধার হয়েছে। চারটি আস্তানাই নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বলে জানিয়েছে পুলিশ। জঙ্গী সংগঠনটি সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এদিকে শুক্রবার রাতে সন্ধান পাওয়া বাড্ডার আস্তানা থেকে ধারালো চাপাতি ও বিভিন্ন ধরনের গুলি উদ্ধার হয়েছে। আর মোহাম্মদপুরের আস্তানা থেকে উদ্ধার হয়েছে মারাত্মক সব বিস্ফোরক। এর মধ্যে রয়েছে- টাইমবোমা, হ্যান্ডগ্রেনেড, টেনিস বলবোমা, সসপ্যানবোমা, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ও টাইমবোমা বানানোর নানা সরঞ্জাম। আটক করা হয়েছে ১৭ জনকে। এর মধ্যে অন্তত পাঁচজন জঙ্গী। অন্যদের নানা কারণে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। মোহাম্মদপুর থেকে উদ্ধারকৃত বোমা দিয়ে মারাত্মক ধরনের ধ্বংসষজ্ঞ চালানো সম্ভব ছিল। ইতোমধ্যেই পাঁচটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বিস্ফোরণের সময় পুরো এলাকা কেঁপে উঠছিল। আস্তানাগুলো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বলে দাবি করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। শুক্রবার রাতে উত্তর বাড্ডার সাঁতারকূলের জিএম বাড়ির তালিমুল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও নূরানী কিন্ডারগার্টেন রোডে অবস্থিত একটি পাঁচতলা বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম বিভাগের একাধিক দল। বাড়িটির নিচতলায় অভিযানকালে ভেতর থেকে জঙ্গীরা এক পুলিশ কর্মকর্তাকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত করে। পুলিশ কর্মকর্তা গুলি চালায়। জঙ্গীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ছুরিকাঘাতে আহত হন ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা বাহার উদ্দিন ফারুকী। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার অবস্থা গুরুতর। রাত বারোটার দিকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। পরে আস্তানায় হানা দিয়ে সালাউদ্দিন ও শাহীন ওরফে কামাল নামে দুই জঙ্গীকে গ্রেফতার করে। এ সময় বাড়ির মালিক বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হানিফ ও তার এক ছেলে এবং বাড়ির এক ভাড়াটিয়াকে আটক করা হয়। জঙ্গী আস্তানা থেকে জিহাদী বইপত্র, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র ও বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি উদ্ধার হয়। সাঁতারকূলের জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে প্রত্যক্ষদর্শী সালাউদ্দিন স্বপন বলছিলেন, তার বাসা আস্তানাটির ঠিক পাশেই। তার চোখের সামনেই ঘটে পুরো অভিযানটি। দোকানে বসে চা পান করছিলাম। আচমকা একটি গুলির শব্দ শুনে সেদিকে দৌড় দেই। দেখি, ডিবির জ্যাকেট পরিহিত চারজন ওই গলিটা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। একজনের মাথায় গুলির আঘাত এবং তার পুরো মুখ রক্তে ভিজে যাচ্ছে। এক ডিবি সদস্য এক রিক্সাচালকের কাছ থেকে গামছা নিয়ে দ্রুত মাথা বেঁধে দেন। অপর সদস্যরা জঙ্গী আস্তানা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। পরে আহত ডিবি কর্মকর্তাকে সিএনজিতে তুলে মেডিক্যালে পাঠাই। দেখতে দেখতে মিনিটি বিশেক পার হয়ে গেল। পুরোটা সময় গোলাগুলি চলল। এর পর আরও পুলিশ এলো। জঙ্গী আস্তানার বাড়িটি নোয়াখাইল্যা বাড়ি নামে পরিচিত। বাড়ি থেকে পরবর্তীতে দু’জনকে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে জানতে পারলাম তারা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। এদিকে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, গ্রেফতারকৃত দুই জঙ্গী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। রাতেই গ্রেফতারকৃত দুই জঙ্গীর দেয়া তথ্যমতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এলাকায় অভিযান চালানো হয়। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন ঢাকা উদ্যানের পাশে নবোদয় হাউজিংয়ের প্রধান সড়কসংলগ্ন ৬ নম্বর সড়কের ২৮ নম্বর পাঁচতলা বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তা বলেছেন, অভিযানের আগেই দুই জঙ্গী পালিয়ে যায়। পরে বাড়ি থেকে বাড়ির মালিক আব্দুল মালেকসহ অন্তত ১৫ জনকে আটক করা হয়। বাড়িটির পাঁচ তলার পূর্ব দিকের ফ্ল্যাটটিতে জঙ্গীরা বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। তিন কক্ষবিশিষ্ট ফ্ল্যাটে দুটি বেডরুম রয়েছে। অপরটি ড্রইং ও ডাইনিং একত্রে। পুরো ফ্ল্যাটে বিস্ফোরক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। ফ্ল্যাটটি চলতি বছরের শুরুতেই মাসিক প্রায় ১৫ হাজার টাকায় ভাড়া নেয়। ভাড়া নিয়েই সেখানে বোমা তৈরির কারখানা স্থাপন করে। এই ফ্ল্যাটে বোমা তৈরি ও মজুদ করা হতো আর সাঁতারকূলের বাড়িটি মূলত হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকে নাশকতার পরিকল্পনা করা হতো। অভিযান পরিচালনাকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই ফ্ল্যাট থেকে অন্তত ৬ কেজি উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক, ৬টি হ্যান্ডগ্রেনেডের আদলে তৈরি অত্যন্ত শক্তিশালী বোমা, ৯ প্রকারের কেমিক্যাল, টাইমবোমা বানানোর বিপুল পরিমাণ সুইচ, রিমোট কন্ট্রোল বোমার সরঞ্জাম, জিহাদী বই ও ট্রেনিংয়ের নানা সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। আর তার ঠিক পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাট থেকে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার নানা সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চলে। রাত হওয়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় অভিযান স্থগিত করা হয়। পরবর্তীতে আবার অভিযান চালানো হবে। পাঁচটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। বোমার আওয়াজ এতটাই ব্যাপক ছিল যে, বিস্ফোরণকালে মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাঁচজন জঙ্গী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বাড়ি জামায়াতের আমির যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামীর বাড়ির কাছেই। সবার বাড়িই পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায়। শনিবার বিকেলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) ও কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা সব মিলিয়ে চারটি জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পেয়েছি। আরও আস্তানার সন্ধানে অভিযান-অনুসন্ধান চলছে। সাঁতারকূলের আস্তানাটি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকে নানা ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা হতো। আর মোহাম্মদপুরের আস্তানাটি মূলত জঙ্গী সংগঠনটির অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বোমা তৈরি এবং মজুদের কারখানা। সাঁতারকূলের বাসাটি চলতি মাসের প্রথম দিকে ভাড়া নেয়। আর মোহাম্মদপুরেরটি ভাড়া নেয় চলতি বছরের প্রথম দিকে। নিজেরা ছাত্র পরিচয়ে এবং ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে ফ্ল্যাট দুটি ভাড়া নেয় জঙ্গীরা। সাঁতারকূলের আস্তানা থেকে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি ও বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই উদ্ধার হয়। সাঁতারকূলের আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত সালাউদ্দিন মূলত মোহাম্মদপুরের আস্তানায় থাকত। আর মোহাম্মদপুরের আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকগুলো খুবই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন। বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন এ ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করে থাকে। উদ্ধারকৃত রাসায়নিক পদার্থ (কেমিক্যাল) খুবই উচ্চমাত্রার। এছাড়া এই প্রথমবারের মতো লিকুইড বিস্ফোরক উদ্ধার হলো। ইতোপূর্বে জেএমবিসহ অন্যান্য জঙ্গী আস্তানা থেকে যেসব বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে, সেসব বিস্ফোরকের সঙ্গে মোহাম্মদপুর থেকে উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকের কিছুর মিল রয়েছে। অন্যগুলোর কোন মিল নেই। বিশেষ করে ইতোপূর্বে লিকুইড বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনা ঘটেনি। আস্তানা দুটি নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আস্তানা থেকে উদ্ধারকৃত নানা বিস্ফোরক ও সরঞ্জাম দেখে বোঝা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সশস্ত্র জিহাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোপূর্বে তারা অপারেশনে চাপাতি ব্যবহার করেছে। তবে উদ্ধারকৃত সরঞ্জাম নতুন ইঙ্গিত বহন করছে। উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকের মধ্যে পাঁচ ধরনের বিস্ফোরক খুবই উচ্চমাত্রার বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিস্ফোরকগুলো জঙ্গীদের হাতে কিভাবে এসেছে সে বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান চলছে। অভিযান পরিচালনাকারী একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বিশেষ করে টেনিস বলবোমা ও সসপ্যানবোমা বিশেষ আতঙ্কের কারণ। বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিস্ফোরণের জায়গা থেকে মাটি ও ইট-পাথর উঠে যায়। বিশেষ করে টেনিস বলবোমা, হ্যান্ডগ্রেনেড আর সসপ্যানবোমাগুলো ছিল মারাত্মক শক্তিশালী। সসপ্যানবোমা দিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা সম্ভব ছিল। আর অন্য বোমাগুলো দিয়েও মানুষকে হত্যা করা সম্ভব ছিল। তবে পরিমাণ কিছুটা কম। এসব লন টেনিস বলবোমা যে কোন জায়গায় ছুড়ে মারলে অনেকেই বিষয়টি তেমন আমলেও নেবে না। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন, বাচ্চাদের খেলার টেনিস বল চলে এসেছে। সেই টেনিস বলই মারাত্মক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে। এছাড়া উদ্ধারকৃত পাঁচ কেজি ওজনের সসপ্যানবোমাটিও মারাত্মক। অনেকেই ধারণা করতে পারেন, সসপ্যানের ভেতরে খাবার রয়েছে। এ ধররের সসপ্যানবোমা দিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করা সম্ভব ছিল। মোহাম্মদপুরের ঘটনাস্থলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম ছাড়াও তেজগাঁওসহ ডিবির দক্ষিণ ও পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার যথাক্রমে বিপ্লব কুমার সরকার, মাশরুকুর রহমান খালেদ ও সাজ্জাদুর রহমান উপস্থিত থেকে সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিং করেন।
×