ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জড়িতদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

দুর্ধর্ষ আলী শিশুদের বালি চাপা দিয়ে হত্যা করে ॥ সুন্দ্রাটিকিতে চার শিশু হত্যাকাণ্ড

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দুর্ধর্ষ আলী শিশুদের বালি চাপা দিয়ে  হত্যা করে ॥ সুন্দ্রাটিকিতে চার শিশু হত্যাকাণ্ড

রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন, হবিগঞ্জ থেকে ॥ পুলিশের খাঁচায় বন্দী দুর্ধর্ষ আব্দুল আলীই সুন্দ্রাটিকি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার স্কুল ছাত্রকে অপহরণের পর বালি চাপা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। শুক্রবার বিকেল সোয়া ৩টায় হবিগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরী প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানান সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ মিজানুর রহমান। এ সময় তিনি বলেন, মুক্তিপণ আদায় বা অন্য কোন কারণে এই কোমলমতি শিশুদের হত্যা করা হয়নি। প্রকৃত অর্থে ব্যক্তি বিরোধের জের ধরেই এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই ঘটনায় ইতোপূর্বে নেয়া অপহরণ মামলাটি এখন হত্যা মামলা হিসেবে গণ্য করার জন্য আদালতে আবেদন করেছে পুলিশ। বিজ্ঞ আদালত তা মঞ্জুরও করেছে। তিনি বলেন, আশা করি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই স্পর্শকাতর মামলাটি ওঠার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন হবে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, এসপি জয়দেব কুমার ভদ্র। এদিকে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামে সংঘটিত স্কুলছাত্র হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার সকালে ওই গ্রাম পরিদর্শন ও নিহত শিশু পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে এই নির্দেশনার কথা জানিয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। এ সময় তিনি নিহত স্ব স্ব পরিবার কর্তাদের হাতে ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন মন্ত্রী। এছাড়া দ্রুত অন্যান্য জড়িতদের গ্রেফতারের জন্য স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেন মন্ত্রী। শুধু তাই নয়, মন্ত্রী চুমকি সন্তান হারানো মা-বাবাদের সান্ত¡না দেয়ার পাশাপাশি এই হত্যাকা- তদন্তের খোঁজ নেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, সিলেট বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া, হবিগঞ্জ-১ আসনের এমপি এম এ মুমিন চৌধুরী বাবু, সিলেট র‌্যাঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূইয়া, জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম ও পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র প্রমুখ। অন্যদিকে কোমলমতি শিশু শুভ, তাজেল, মনির ও ঈসমাইলকে নির্মমভাবে হত্যার পর গোটা গ্রামে এখনও বিরাজ করছে ভয় ও উৎকন্ঠা। নিহত ছাত্রদের সকল সহপাঠীরাই এখন তাদের বন্ধুকে হারিয়ে একা হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে স্কুলে যেতেও তাদের খারাপ লাগছে। বসছে না পড়াশোনায় মন। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে অপহরণ আতঙ্কে পাচ্ছেন না সাহস। ফলে এইসব ছাত্রদের স্কুলে যাওয়া একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার এই গ্রাম ও সুন্দ্রাটিকি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সরেজমিন ঘুরে কোমলমতি শিক্ষার্থী-শিক্ষক, অভিভাবক সহ-সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই নির্মম হত্যাকা-টি সংঘটিত হবার আগে সংশ্লিষ্ট গ্রামের সাধারণ মানুষ নাকি সুন্দ্রাটিকি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উচ্চৈঃস্বরে পড়াশোনার শব্দ শুনতেন। এই শিশুদের কিচিরমিচির মনোমুগ্ধকর পড়ার শব্দ মানুষের মন ভরে যেত। শুধু তাই নয়, স্কুল মাঠে শুভ, তাজেল, মনিরের মতো অনেক শিশুদের দুরন্তপনা ছিল গ্রামে নানা রসাত্মক আলোচনার নতুন পাঠ। বৃহস্পতিবার এই স্কুলটি ঘুরে দেখার সময় মাত্র ৫ থেকে ৭ জন শিশুকে এদিক ওদিকসহ ক্লাসে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়। অপহরণ আতঙ্কে একেবারেই কমে গেছে শিক্ষার্থী হাজিরা। প্রতিটি শ্রেণী কক্ষে বেঞ্চগুলো পড়ে রয়েছে ফাঁকা। ৩য় শ্রেণীতে ৭ জন শিক্ষার্থীও উপস্থিতি মিললেও ৫ম শ্রেণীতে কোন ছাত্রই নেই। ৪র্থ শ্রেণীতে ৪৮ জনের মধ্যে ৭ জন ছিল শিক্ষার্থী। কথা হলো এই স্কুলের ছাত্র নিহত তাজেলের সহপাঠী বশিরা, লুবনার সঙ্গে। এই দুজনই জনকণ্ঠকে জানালেন, মূলত অপহরণ ভয় আতঙ্কেই স্কুলে আসতে কেউ সাহস পাচ্ছে না। চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষক নুরে জান্নাত জানান, ওই নিহত চার শিশুই ছিল নম্র-ভদ্র। স্কুলেরও নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল তাদের। বাবা-মায়েরাও সন্তানদের স্কুলে সময়মতো পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন। এ সময় এই বিদ্যালয়ের উপস্থিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই নির্মম হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের ফাঁসি দাবি করে বলেন, নয়তো পড়াশোনায় শুধু শিশুরাই আগ্রহ হারাবে না বরং অভিভাবকরাও ভয়ে তাদের সন্তান পাঠাতে চাইবে না। ফলে এই এলাকায় শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। এদিকে এলাকায় এখনও রয়েছে পুলিশ টহল ও সার্বক্ষণিক নজরদারি। এদিকে সন্তানদের হারিয়ে এখন বার বার মূর্ছা যাচ্ছে তাদের বাবা-মা। তারা প্রিয় সন্তানের কবরের পাশে কিছুক্ষণ পরপরই ছুটে গিয়ে বুক ফাটিয়ে চিৎকার আর কান্নায় নিজেকে অস্থির করে তুলছেন। মহান আল্লাহর নিকট দু’হাত তুলে প্রার্থনা জানিয়ে বলছে,আল্লাহ তুমি আমাদের সন্তানদের ভাল রেখো-বেহেস্ত দিও আর বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়া এই সব নরঘাতকদের বিচার কর। তাদের এই অবস্থায় দেখে গ্রামের সাধারণ মানুষও আবেগাপ্লুত হয়ে নিজেকে সামলাতে পারছেন না। অপহরণে ব্যবহৃত অটো রিক্সা উদ্ধার ॥ হবিগঞ্জের উপজেলা বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপহৃত চার ছাত্রকে উঠিয়ে নেয়ার কাজে ব্যবহৃত সিএনজি চালিত অটো রিক্সাটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়ার বাড়ির গোয়াল ঘর থেকে এই অটো রিক্সাটি (হবিগঞ্জ-থ-১১-৩৬০৮) উদ্ধার করা হয়। তবে এ সময় কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।
×