ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট ;###;রাস্তায় ৩০ ধরনের গাড়ি চলে;###;সাইনবোর্ডের নির্দেশ কেউ মানে না;###;ফুটপাথ দখলমুক্ত হলে যানজট কমবে ৩০ ভাগ

রাজধানীতে যানজটে দিনে ক্ষতি ॥ ৩শ’ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

রাজধানীতে যানজটে দিনে ক্ষতি ॥ ৩শ’ কোটি টাকা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ পুরানা পল্টন মোড় পার হয়ে প্রেসক্লাবের দিকে যেতে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনের রাস্তায় একটি সাইনবোর্ড। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে দেয়া এই সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘এখানে বাস থামানো নিষেধ’। তাতে কি! গুলিস্তান কিংবা মতিঝিল থেকে আসা সব বাস এখানে থামছে। তোলা হচ্ছে যাত্রী। ফলে সিগন্যাল জটে পড়তে হচ্ছে তিনদিকের যানবাহনগুলোকে। কাকরাইলেও এ চিত্র প্রতিদিনের। মহাখালী বাস টার্মিনালের উভয় পাশের সামনের রাস্তায় পুলিশের দেয়া সাইবোর্ডে ‘বাস থামানো নিষেধ’ লেখা রয়েছে। সেখানেও কারণে অকারণে বাস থামে। যাত্রী ওঠানামার চিত্র সব সময়ের। নগরীর অন্তত ৫০টি পয়েন্ট ঘুরে এ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। যানজট নিরসনে ট্রাফিক বিভাগের সাইনবোর্ডের নির্দেশনা কার্যত অকার্যকর। পরিবহন চালকরাও জানেন না, থামা ও না থামার নির্দেশনা দেয়ার কথা। পুলিশও এ ব্যাপারে তৎপর নয়। খোদ মতিঝিলেই মানার চিত্র চোখে পড়েনি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে যানজট নিরসনে পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ এই পদক্ষেপ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? সত্যিই তাই। দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে নগরীর যানজট সমস্যা। রাস্তায় নামলে কখন গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে নিশ্চয়তা নেই। নিত্য দুর্ভোগ রাস্তায় রাস্তায়। অপেক্ষা ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এ কেমন নগরী! যেখানে যানজটের ভয় নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়। তাহলে সহসাই কি সঙ্কট থেকে মুক্তি নেই? হয়ত না। সে রকম কোন লক্ষণও নেই। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় স্বল্পমেয়াদী পরামর্শগুলো কার্যকর করা গেলে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আসতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলোও যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। এতে দুর্ভোগ বাড়ছে। অনেক প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। গবেষকরা বলছেন, যানজটের কারণে দিনে ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা। এতে মহানগরীর ৭৩ ভাগ মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিও হচ্ছে। রাজধানীর সকল মানুষের দুই ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে গড়ে এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট সময়ই যানজটে আটকে থাকতে হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যানজটের প্রধান কারণ ১৯টি। গবেষকরা বলছেন, রাজধানীতে ৩০ ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলছে। সোয়া দুই লাখের স্থলে সাড়ে নয় লাখ গাড়ি চলাচলের অনুমোদন কোন অবস্থাতেই সুখকর নয়। উল্টো পথে চলা ও আইন না মানা, কার পার্কিংয়ের স্থানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল অর্থাৎ আট ভাগ সড়কের মধ্যে কার্যকর রাস্তা মাত্র আড়াই ভাগ, সিএনজি স্টেশন, স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা না থাকা, ট্রাফিক সদস্যদের প্রশিক্ষণের অভাবেই যানজট হচ্ছে। পাশাপাশি উন্নয়ন কাজ সময়মতো না হওয়াকেও যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে দিনে ৩১৭টি নতুন গাড়ির অনুমোদন দেয়া সঠিক নয়। তাছাড়া অবৈধ পার্কিং বন্ধ, ফুটপাথ ও রাস্তা দখলমুক্ত করলেই ৩০ ভাগ যানজট কমে আসবে। নগরীতে হেঁটে চলাচল করেন ৬০ ভাগ মানুষ। রিক্সায় ১৯ ভাগ। বাস ও অটোরিক্সায় ১৬ ভাগ, প্রাইভেটকারে মাত্র ৫ ভাগ মানুষ যাতায়াত করেন অথচ প্রাইভেটকার অনুমোদন দেয়া হচ্ছে বেশি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি করে গণপরিবহন নামানোর প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান জনকণ্ঠ’কে বলেন, যানজট সমাধানে ট্রাফিক আইন মেনে চলা, ভিজিলেন্স টিম গঠন, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানা করতে হবে। ইন্টার সেকশনের কাছে স্টপেজ বন্ধ করতে হবে। অবৈধ পার্কিং, ফুটপাথ ও রাস্তা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে দখলমুক্ত করা সম্ভব হলে ৩০ ভাগ যানজট কমবে। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই বড় বলে মনে করেন তিনি। নগরীর ২০ ভাগের বেশি রাস্তা দখলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যানজট নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদী প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না করলে জনদুর্ভোগ আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। কেস স্টাডি ॥ মুগদা বিশ্বরোডের পাশেই একটি সিএনজি স্টেশন। গ্যাস নিতে কয়েক শ’ গাড়ির লাইন থাকে প্রতিদিন সকাল থেকেই। সব গাড়িই রাখা হয় মূল সড়কে। এর মধ্যে বিশ্বরোড থেকে মান্ডা গলির মাথায় দ্বিতীয় সারিতে রাখা হয় ২০টির বেশি ম্যাক্সি। মতিঝিল-মুগদা রোডে এসব গাড়ি যাতায়াত করে। এর একটু পরেÑ আইডিয়াল স্কুলের সামনে অবৈধ গাড়ি পার্কিং তো আছেই। এ কারণে খিলগাঁও চৌরাস্তা থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত পাঁচ মিনিটের রাস্তা যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘণ্টা! কমলাপুর কন্টেনার ডিপোর গেটের সামনে ২৪ ঘণ্টাই ওয়াগন, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ অর্ধশত গাড়ি রাখা হয় মূল সড়কে। রাতে এর সংখ্যা বাড়ে। কোন কোন সময় মালামাল ওঠানামাও চলে সড়কের মধ্যেই। এ কারণেই স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারে না। ফল যথারীতি যানজট। সময় যাচ্ছে রাস্তায় ॥ রাজধানীতে যানজটের ফলে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষের দৈনিক দুই কোটি ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হওয়ায় দিনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের (আইইবি) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। সেমিনারে গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ হলো অবৈধ পার্কিং এবং বহুতল ভবনের কার পার্কিংগুলো ভিন্ন কাজে ব্যবহার করা। এরই মধ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এসব ভবনের কার পার্কিংগুলো থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম শুরু করেছে। এটা করা হলে রাজধানীর যানজট কিছুটা হলেও কমবে। যানজট নিরসনের জন্য রিক্সা উচ্ছেদের পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, অন্তত অবৈধ রিক্সাগুলোর চলাচল দ্রুত বন্ধ করতে হবে। মেয়র আনিসুল হক যানজট নিরসনে তাঁর নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, এরই মধ্যে নয়টি স্থানকে তিনি যানজটমুক্ত করেছেন। গাজীপুর থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত ইউ-লুপ স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজও শুরু হয়েছে। এসব সিসি ক্যামেরাকে পুলিশের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হবে। ট্রাফিক পুলিশ সিসি ক্যামেরার ছবি দেখে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, রাজধানীর যানজট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও মফস্বল পর্যায়ে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় স্থানান্তর করা যেতে পারে। মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয়হীনতা, ট্রাফিক আইন না মানা, পর্যাপ্ত সড়ক না থাকা, রাস্তা দখল, রাস্তায় পার্কিংসহ প্রভৃতি সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে হলে নাগরিকদের সচেতন হওয়াসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে নতুন বছরে রাজধানীর যানজট সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, যানজটের বিষয়টা আসলে খুব একটা অগ্রসর হয়নি। তবে যানজট নিরসনের আপাত ব্যবস্থা দৃশ্যমান না হলেও সমাধানের পথ আমরা খুলছি। একটু সময় লাগবে। নগরের যানজটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার কথা মনে করিয়ে অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে কাদের বলেন, এখানে সমন্বয়ের অভাব ছিল। যে কারণে যানজট নিরসনে কোন শুভফল বয়ে আনতে পারিনি। এখন আমরা সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। রেজাল্ট পাব। তিনি বলেন, যানজট এখন জাতীয় দুর্ভোগ। তাই সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া রাজধানীর যানজট নিরসন সম্ভব নয়। দুঃখ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, নগরীর ফুটপাথগুলো পথচারীদের ব্যবহারের বদলে অন্যরা দখল করে ব্যবহার করছে। পথচারীরা ফুটপাথে হাঁটতে না পেরে সড়কের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। এতে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। জানা গেছে রাজনৈতিক মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা আছে ফুটপাথ দখলের পেছনে। তাই ফুটপাথগুলো পথচারীদের জন্য ছেড়ে দিতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যত উদ্যোগ ॥ রাজধানীর হাতিরঝিলের তেজগাঁও অংশ থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার সড়কে ২২টি ইউলুপ (ইউ আকৃতির সেতু) নির্মাণ করবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এই ইউলুপ নির্মাণ করতে এ সড়কের ৬৯টি ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া হবে। আর ইউলুপগুলো নির্মাণ হলে এ সড়ক থেকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ যানজট কমে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাঁচটি মেট্রোরেল ॥ আগামী ২০ বছরে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ শতাংশ বাড়বে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে যানবাহনও। এ সময়ের মধ্যে নগরবাসীর দৈনিক যাতায়াত (ট্রিপ) বাড়বে প্রায় ৭১ শতাংশ; যা রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা বাড়াবে দ্বিগুণ। পরিস্থিতি উত্তরণে ঢাকায় আগামী ২০ বছরে পাঁচটি মেট্রোরেল চালু করতে হবে। পাশাপাশি দুটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), নতুন কয়েকটি সড়ক ও এক্সপ্রেসওয়েও নির্মাণ করতে হবে। রাজধানীর যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) সংশোধনসংক্রান্ত দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ; যা ২০৩৫ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২ কোটি ৬৩ লাখে। এ সময় ট্রিপের সংখ্যা ২ কোটি ৯৮ লাখ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৫ কোটি ১১ লাখে। কিন্তু বিদ্যমান সড়ক ব্যবস্থায় এ যাতায়াত সম্ভব নয়। ফলে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা তথা মেট্রোরেল ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করতে হবে। এ জন্য বর্তমানে চলমান প্রকল্পসহ রাজধানীতে পাঁচটি মেট্রোরেল নির্মাণ করতে হবে। এতে বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে প্রায় ২ হাজার ৫৬ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৫৯ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক বলেন, রাজধানীর যানজট নিরসনে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা তথা মেট্রোরেল ব্যবস্থা উন্নয়নের বিকল্প নেই। জাইকাও বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। এমআরটি-১ প্রকল্পটি নিয়ে সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনাও চলছে। চীনের সঙ্গেও একটি মেট্রোরেল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রসঙ্গত. রাজধানী ও আশপাশের জেলা যানজটমুক্ত করতে ২০০৪ সালে প্রণয়ন করা হয় ২০ বছর মেয়াদি স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি)। তবে সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে ১০ বছরেই প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে এটি। তাই এসটিপি সংশোধন করা হচ্ছে। জাইকার অর্থায়নে এ জন্য কাজ করবে জাপানের তিন প্রতিষ্ঠান। নগরীর যানজট প্রসঙ্গে সংসদে দেয়া এক বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, যানজটমুক্ত ঢাকা শহর গড়ে তুলতে মেট্রোরেলের কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, ২০১৯ সাল নাগাদ এর কাজ শেষ করতে পারব। যানজট সমস্যা সমাধানে আমাদের চলমান অন্যান্য উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে, ৩৮ দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা শহরের জাহাঙ্গীর গেট এলাকায় ফ্লাইওভার ও আন্ডারপাস এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হতে কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ। এ ছাড়া গাজীপুর হতে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত এবং বিমানবন্দর হতে ঝিলমিল পর্যন্ত বাস রেপিড ট্রানজিট নির্মাণের রুট সমীক্ষা এবং প্রাথমিক নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। দ্রুত গতিতে চলছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ। তিনি বলেন, তবে আমার ব্যক্তিগত মত হলো, রাজধানীর যানবাহন ব্যবস্থাপনার জন্য একটি স্বতন্ত্র সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন আছে। কার পার্কিংয়ের স্থানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ॥ ঢাকার যানজট নিরসনে রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন সড়কের পাশে নির্মিত যেসব ভবনের কার পার্কিংয়ের স্থানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকান তৈরি করা হয়েছে তার একটি তালিকা চেয়েছে হাইকোর্ট। সম্প্রতি জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের শুনানি করে হাইকোর্টের বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আগামী দুই মাসের মধ্যে উক্ত তালিকা আদালতে জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অপসারণে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে আদালত। রিট আবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে যানজটের অন্যতম কারণ হলো রাস্তার পাশে নির্মিত বহুতল ভবনের কার পার্কিয়ের স্থানে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়। জায়গা না থাকায় রাস্তায় কার পার্কিং করা হয়। এ কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। ঢাকার যানজট এখন চরম আকার ধারণ করেছে। গুলশান, বনানী ও বারিধারায় ২০৮টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করলেও কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি রাজউক। যানজট নিরসনে পুলিশের প্রতিবেদন ॥ যানজট নিরসনে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। যেখানে রাজধানীতে যানজটের ১৯টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া যানজট থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে অপ্রশস্ত রাস্তা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে হাট-বাজার, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, দোকানপাট বসানো, রাস্তায় নির্মাণ সামগ্রী রাখা, আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবনে কার পার্কিং না থাকা, পার্কিং থাকলেও বন্ধ রাখা, রাস্তায় যত্রতত্র বাস, মিনিবাস ও অটোরিক্সা থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশ, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন, রাজউকসহ সরকারী অন্য সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করা হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঢাকা মহানগরীতে ২১৯টি বাস স্টপেজ এবং বিআরটিসি কর্তৃক অনুমোদিত ২০৮টি বাস রুট রয়েছে। বিআরটিসি ও বেসরকারী মিলিয়ে প্রতিদিন ১২ হাজার বাস/মিনিবাস এই রুটগুলোয় যাত্রী পরিবহন করে থাকে। বাস স্টপেজে বাস না থামিয়ে মূল রাস্তার ওপর বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। এ ছাড়া আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো নগরীর অভ্যন্তরে হওয়ার কারণে যানজট সৃষ্টি হয়। এ ছাড়াও ঢাকা মহানগরীর ব্যস্ততম বিভিন্ন রাস্তায় ২০টি পয়েন্ট, লেবেল ক্রসিং রয়েছে। প্রতিদিন ট্রেনের আপ ও ডাউন মিলিয়ে দৈনিক ৪-৫ ঘণ্টা সময় লেবেল ক্রসিংগুলোয় যানবাহন আটকে থাকে। এ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফিটনেসবিহীন যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ এবং পুরনো যানবাহন রাস্তায় চলার কারণেও যানজট সৃষ্টি হয়। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মহানগরী একটি অপরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। নগর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকার জমির মালিকদের ভূমি ব্যবহারে অদূরদর্শিতাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা শহরের ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ৮ শতাংশ ভূমি রাস্তা হিসেবে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি আদর্শ নগরীর জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ ভূমি রাস্তার জন্য প্রয়োজন হলেও ঢাকা মহানগরীর মাত্র ৮ শতাংশ ভূমি রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই ৮ শতাংশ রাস্তার মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩ লাখ ২৫ হাজার যান্ত্রিক যান এবং ৭ লাখ রিক্সা চলাচল করে, এসব রিক্সার মধ্যে ৬ লাখ ২০ হাজারই অবৈধ। চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা ব্যবহৃত রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। উপরন্তু প্রতিদিন ৩১৭টি নতুন যান্ত্রিক যান রাস্তায় নামছে। ঢাকা মহানগরীর রাস্তায় ঠেলাগাড়ি থেকে রেলগাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৩০ প্রকার যান চলাচল করে থাকে। রাস্তায় দ্রুতগতি ও ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহন এবং একই সঙ্গে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করার ফলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
×