ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ অংশের ১ কিমি নির্মাণে ভারত দেবে ৪শ’ কোটি রুপী ;###;বাস্তবায়নে সময় নেবে আড়াই বছর;###;বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হবে উভয় দেশ

অবশেষে শুরু করা হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণকাজ

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৫ আগস্ট ২০১৫

অবশেষে শুরু করা হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণকাজ

মশিউর রহমান খান ॥ চার বছর অপেক্ষার পর অবশেষে শুরু করা হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সীমানার ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথটি নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুর করেছে ভারত সরকার। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ অংশের জন্য ৪০০ কোটি রুপী বরাদ্দ ঘোষণা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, রেলপথটি চালু হলে ভারত বেশি লাভবান হবে তবে, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ঐসব রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের নতুন পথ খুলবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করবে বিধায় বাংলাদেশও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করতে সক্ষম হবে। এ রুটটি চালু হলে ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে বাংলাদেশ হয়ে কলকাতা যেতে প্রায় ১৩শ’ ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে ও একইসঙ্গে সময়ও বাঁচবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ২ থেকে আড়াই বছর সময় লাগবে। তবে প্রকল্পের অর্থ দ্রুত প্রাপ্তির ওপর নির্মাণ সময় নির্ধারণ করছে। আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত সম্পূর্ণ এ রেলপথটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮০ কোটি রুপী অথচ ২০১১ সালে মোট ১৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৮৬ কোটি রুপী। চার বছর পর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বিলম্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় বেড়েছে ৫৯৪ কোটি রুপী বা ১৫৩ শতাংশ। পূর্বে মিটারগেজে লাইনটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও সিদ্ধান্ত বাতিল করে ডুয়ালগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হবে। অপরদিকে জানা গেছে, ভারতের অংশে এ রুটটি চালু করতে ৫ কিলোমিটার রেললাইন তৈরি করতে হবে। যা বেশিরভাগ অংশে ফ্লাইওভার তৈরি করাসহ আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন রেললাইন তৈরি করতে হবে। এর আগে ভারতের অংশের রেললাইনটি মাটিতে নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর ফলে পূর্বের ব্যয়ের তুলনায় বর্তমানে ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে যায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দু’দেশ উদ্যোগ নিলেও প্রকল্পটি চালু করা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, এর আগে, প্রকল্পটির অর্থায়নে ভারতের সঙ্গে ২০১৩ সালে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হলেও তাতে অনুদানের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের পরই আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি গতি ফিরে পায়। তবে ভারতের রেল বাজেটে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ ছিল না। ফলে সম্প্রতি প্রকল্পটি অর্থায়নের ঘোষণা দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এক্ষেত্রে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুদান অনুমোদনের ঘোষণা দেয়া হয়। জানা গেছে, রেলপথটি তৈরিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারসহ ত্রিপুরা রাজ্য সরকার রাজি হয়েছে। অপরদিকে প্রকল্পটি শুরু করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে শীঘ্রই প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। নির্মাণ ব্যয় মোট ৯৮০ কোটি রুপীর মধ্যে সাড়ে তিন কিলোমিটার উড়াল রেলপথসহ ভারতের পাঁচ কিলোমিটার অংশের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮০ কোটি রুপী। আর বাংলাদেশ অংশের ১০ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি রুপী (৪৮০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা)। রেল সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে ত্রিপুরা থেকে শিলিগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গে যাতায়াত করতে হয়। এতে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে কলকাতার দূরত্ব দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। ভারত সরকার বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ত্রিপুরার দূরত্ব কমাতে আগ্রহী। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে এ রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠা হলে আগরতলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার দূরত্ব হবে মাত্র ৩৫০ কিলোমিটার। এতে প্রায় ১৩শ ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব ও সময় উভয়ই কমবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এছাড়া উপকূলীয় নৌযান চলাচল চুক্তি বাস্তবায়ন ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে রেলপথটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ পথের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বাড়বে। রেলওয়ের তথ্যমতে, আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণে ২০১১ সালে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (ইরকন) সম্ভাব্যতা যাচাই করে। তারাই এ রেলপথটি নির্মাণ করবে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ে নির্মাণকাজ তদারকি করবে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নে ৫৬ দশমিক ৫১ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। জমি অধিগ্রহণ ও রেলপথ নির্মাণসহ প্রকল্পের পুরো ব্যয়ই ভারত সরকার বহন করবে। বাংলাদেশ অংশে ১০ কিলোমিটার মূল রেলপথ ছাড়াও ৪ দশমিক ২৫ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া তিনটি স্টেশনে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিগন্যালিং ব্যবস্থাও স্থাপন ও প্রকল্পটির আওতায় তিনটি মেজর ও ২০টি মাইনর ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। এ জন্য রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা ও প্রকল্পের আওতায় কাস্টম শুল্ক ও ভ্যাট বাবদ বাংলাদেশ সরকারের ৫৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয় হবে। যা সরকারের তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে। জানা গেছে, রেলপথ মন্ত্রণালয় আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্পের বাংলাদেশ অংশের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) চূড়ান্ত করেছে। গত জানুয়ারিতে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পিইসি বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির অর্থায়নে ভারতের সঙ্গে ২০১৩ সালে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। কিন্তু তাতে অনুদান করা দেবে বা অর্থায়নের উৎসের কথা উল্লেখ ছিল না। এছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ভারত সরকার কত টাকা দেবে তা-ও নিশ্চিত নয়। তাই বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের অনুদানের বিষয়টি আগে নিশ্চিত হতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারিতে ভারতের দূতাবাসের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ভারতের কাছ থেকে কোন জবাব পাওয়া যায়নি। ফলে এ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে গত জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় আখাউড়া-আগরতলা প্রকল্পের অর্থায়নসহ বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনা হয়। তখন নরেন্দ্র মোদি প্রকল্পটিতে ভারতের অর্থায়নের আশ্বাস দেন। উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত এ রুটটি ছাড়াও ভারতের সঙ্গে বর্তমানে দর্শনা-গেদে, রোহানপুর-সিঙ্গাবাদ, বেনাপোল-পেট্রাপোল রুটে দুই দেশের মধ্যে রেল চালু আছে। এছাড়া বিরল-রাধিকাপুর সংযোগ স্থাপন কাজ চলছে। আর শাহবাজপুর-মহিষাশন রেল সংযোগ স্থাপন প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে, যা শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। এছাড়া চিলাহাটি-হলিদাবাড়ী ও ফেনী-বেলুনিয়া রুট চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, কয়েক বছর পরে হলেও বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের তুলনায় ভারত তার নিজস্ব প্রয়োজনেই আখাউড়া-আগরতলা রেলপথটি বেশি ব্যবহার করবে। ফলে ২০১১ সালে এ প্রকল্পটির অর্থায়নে অনুদানের আশ্বাস দেয় ভারত। এরপর এ নিয়ে ২০১৩ সালে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে একটি এমওইউও সই হয়।
×