ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিলাসবহুল ব্যবস্থাপনায় অর্থ অপচয়ের অভিযোগ

আমানতকারীরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত, উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণ পাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৮ এপ্রিল ২০১৫

আমানতকারীরা মুনাফা থেকে বঞ্চিত, উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণ পাচ্ছে না

রহিম শেখ ॥ কাগজ-কলমে হিসাব না রেখে বেনামে খরচের অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে। বিলাসবহুল ব্যবস্থাপনায় অর্থের অপচয়, বেআইনী প্রভাব খাটিয়ে পরিচালকদের অবৈধ সুবিধা ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) মাত্রাতিরিক্ত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়ের বিলাসবহুল সাজসজ্জা, শাখা সজ্জা, গাড়ি ও এটিএম বুথ স্থাপনের নামে মাত্রাতিরিক্ত টাকা খরচ করা হচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড)। আমানতের সুদের হার কমিয়েও কমানো যাচ্ছে না ঋণের সুদের হার। এতে আমানতকারীরা যেমন মুনাফা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি উদ্যোক্তারাও পাচ্ছেন না কম সুদের ঋণ। জানা গেছে, বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, চেয়ারম্যান ও এমডিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল গাড়ি, নতুন শাখা স্থাপন, চাকচিক্য, সাজসজ্জা ও সিএসআরের নামে অস্বচ্ছভাবে অর্থব্যয়সহ নানাভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ব্যয় বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, এ অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টানতে গত বছরের শুরুতে সার্কুলার জারি করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নির্দেশনা অনুসারে কোন ব্যাংক ৫০ লাখ টাকার বেশি দামে মোটরকার এবং এক কোটি টাকার বেশি দামে জিপ ক্রয় করতে পারবে না। কিন্তু ব্যাংকের অর্থে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, প্রধান নির্বাহী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার জন্য বিলাসবহুল মোটরগাড়ি ক্রয় করা হচ্ছে। এছাড়া নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও নতুন শাখা স্থাপন বা বিদ্যমান শাখা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে শহর শাখার জন্য পাঁচ হাজার বর্গফুট এবং পল্লী শাখার জন্য দুই হাজার বর্গফুটের অধিক ফ্লোর স্পেস ব্যবহার করা হচ্ছে। আইটি সরঞ্জাম খাতেও ব্যয় যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে রাখার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। আসবাব ও অন্যান্য সরঞ্জামে বিলাসিতা বা চাকচিক্যের বদলে মৌলিক প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত গুণগত মান ও টেকসইর বিষয়টি বিবেচনা হয় না। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি তদন্তে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ স্থাপনে পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ভবন বেশি দামে ভাড়া নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। কঠোর মনিটরিংয়ের ফলেই ইতোমধ্যে বেশকিছু জালিয়াতি শনাক্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, যেখানেই ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্তি খরচ বা অনিয়মের সন্ধান মিলছে সেখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে অবশ্যই আগের চেয়ে তাদের কস্ট অব ফান্ড কমেছে। একই সঙ্গে সুদের হারও কমছে। সূত্র মতে, ব্যাংকগুলো তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের একটি বড় অংশই চলে যায় আমানতকারীদের দেয়া মুনাফার বিপরীতে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে আমানত সংগ্রহের খরচ (কস্ট অব ডিপোজিট) ৬ থেকে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানত সংগ্রহে ব্যাংকগুলোকে খরচ করতে হচ্ছে ৬ থেকে ৮ টাকা। এই ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হচ্ছে গড়ে সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ। ১০০ টাকার তহবিল পরিচালনা করতে তাদের খরচ হচ্ছে সাড়ে ৯ থেকে সাড়ে ১২ টাকা। অর্থাৎ আমানতের খরচের বাইরে ব্যাংকগুলোর প্রতি ১০০ টাকায় আরও ব্যয় হচ্ছে সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৪ টাকা। অর্জিত মুনাফা থেকে ব্যাংকগুলো এই ব্যয় মেটাচ্ছে। এই আয় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রেই চলছে বেশিরভাগ অনিয়ম। কয়েকটি ব্যাংক তাদের প্রধান কার্যালয়কে রাজকীয়ভাবে সাজসজ্জা করায় তাদের খরচ বেড়ে গেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনেও বেসরকারী খাতের ৮ ব্যাংকের বিরুদ্ধে কাগজ-কলমে হিসাব না রেখে বেনামে খরচের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০০৭-০৮ এবং ২০০৮-০৯ অর্থবছরের হিসাবের ওপর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের বার্ষিক অডিট রিপোর্টে এসব ব্যাংকের কোন ব্যাংকের আয়-ব্যয়ের লিখিত কাগজ (ভাউচার) পাওয়া যায়নি। সূত্রে জানা যায়, পরিচালকরা বেনামে ঋণ নিয়ে বা নিজ নামে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধ না করে কিংবা সুদ মওকুফ করিয়েও ব্যাংকের আয় কমিয়ে তহবিল ব্যয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছেন। ব্যাংকগুলোতে পরিচালকদের বেনামি ঋণ আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। যেগুলোকে পরে শনাক্ত করে তাদের নিজ নামে দেখানো হয়েছে। নিজ নামে নেয়া ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বিপরীতে তারা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা নিয়ে খরচ বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখছেন। এসব কারণে ব্যাংকগুলো বেশিরভাগ ঋণের বিপরীতে সুদের হার কমাতে পারছে না। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) মাত্রাতিরিক্ত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। ব্যাংকের পরিচালকদের ভাতা নির্ধারণ করে দিলেও এমডিদের ব্যাপারে সে রকম কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ২৯টি বেসরকারী ব্যাংকের এমডি মোট বেতন-ভাতা মিলিয়ে ৩৩ কোটি টাকা নিয়েছেন। আগের বছরের চেয়ে যা প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। আলোচ্য সময়ে গড়ে প্রতিটি ব্যাংকের এমডি নিয়েছেন ১ কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতন নিয়েছেন সিটি ব্যাংকের এমডি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্তে দেখা গেছে, নিজ ব্যাংক থেকে পরিচালকরা যেসব বেআইনী ঋণ বা অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন তার সবগুলোই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের এমডিরা জানতেন। অথচ এটি বন্ধ করা বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানানোর দায়িত্ব ছিল এমডিদের। কিন্তু তাঁরা সেটি করেননি। জানা গেছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণেও ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যয় বাড়ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো প্রায় ৯ হাজার ১২২ কোটি টাকার সুদ আয় থেকে বঞ্চিত। কিন্তু ব্যাংকগুলো ওই সুদ হিসাব করলেও ঋণখেলাপি হওয়ায় তা আদায় করতে পারেনি। ফলে ওইসব সুদ আয় খাতে নিতে পারেনি। এছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। শুধু মন্দ ঋণের বিপরীতেই ব্যাংকগুলোকে ২০ হাজার কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে হয়েছে। এছাড়া অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন। এসব কারণেও ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যয় বাড়ছে। ফলে ত্রিমুখী ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যাংকগুলো। একদিকে ওই পরিমাণ তহবিল আটকে রয়েছে। এর বিপরীতে আমানতকারীদের সুদ দিতে হচ্ছে। এসব তহবিল বিনিয়োগ করে কোন আয় আসছে না। উল্টো এসব ব্যবস্থাপনায় আরও খরচ হচ্ছে। খেলাপি হওয়ার কারণে এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফার একটি অংশ আটকে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে আমানতকারীদের মুনাফা কম দিতে হচ্ছে। উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন না কম সুদের ঋণ।
×