ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়ে ও ভাতিজার মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ

শেষ কর্মদিবসেও ৫০ জনকে চাকরি দিলেন চবির বিদায়ী ভিসি

চট্টগ্রাম অফিস/চবি সংবাদদাতা

প্রকাশিত: ০০:২৪, ২১ মার্চ ২০২৪

শেষ কর্মদিবসেও ৫০ জনকে চাকরি দিলেন চবির বিদায়ী ভিসি

ড. শিরীণ আখতার

শেষ কর্মদিবসেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) বিদায়ী ভিসি ড. শিরীণ আখতার নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে ৫০ জনকে চাকরি দিয়ে গেছেন। এরা সবাই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। অস্থায়ী ভিত্তিতে এদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এই ভিসি দীর্ঘ সাড়ে চার বছরেরও বেশি কার্যকালে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে দেড়শ’ নিয়োগ দিয়েছেন।

অধিকাংশ নিয়োগ অবৈধ পথে দিয়ে বিপুল অংকের অর্থ গ্রহণ করার জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মিডিয়া হিসেবে কাজ করেছে শাওন নামে ভিসির এক ভাতিজা (বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ে কর্মরত) ও নিজকন্যা টিনা। ড. শিরীণ আখতার প্রথমে রুটিন দায়িত্ব ও পরবর্তীতে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আদেশে ৪ বছর ৯ মাস দায়িত্ব পালনের নামে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে নিয়োগ বাণিজ্যে তৎপর ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। 
অস্থায়ী কোনো মাস্টাররোল দৈনিক ভিত্তিক এবং সৃষ্টপদে (যা এখনো অননুমোদিত) যথেচ্ছ নিয়োগের ফলে আগামী ২০৩২ সাল পর্যন্ত এ বিশ^বিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে আর কোনো নিয়োগের প্রয়োজন হবে না। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোকজন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইন বহির্ভূত এসব কর্মকা-ের জন্ম দিয়ে ভিসি শিরীণ আখতার চলে গেছেন। তবে শেষদিনেও কেলেঙ্কারির জন্ম দেওয়ায় ক্যাম্পাস জুড়ে ব্যাপকভাবে সমালোচনায় পড়েছেন। 
অপরদিকে, এ বিশ^বিদ্যালয়ে বিদায়ী ভিসি দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে জড়িয়েছিলেন। অনিয়ম দুর্নীতির খবর দেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় শিরোনাম হয়েছে। ক্যাম্পাস সূত্র জানিয়েছে, বিগত সাড়ে চার বছরেরও অধিক সময় ধরে ভিসি পদে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিদায়ী ভিসি ড. শিরীণ আখতার উল্লেখযোগ্য কোনো ইতিবাচক কর্মকা- দেখাতে পারেননি। উপরন্তু অনিয়ম দুর্নীতির কারণে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত হয়েছেন এই বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম এই নারী ভিসি।
বিগত করোনাকালীন বন্ধ ক্যাম্পাসে আপ্যায়ন বাবদ ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। এ ছাড়া ওই সময়ে শিক্ষার্থীর বহনকারী শাটল ট্রেন বন্ধ থাকলেও ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এসব ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ২০২৩ সালে মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ অনুষদের একাডেমিক ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা ব্যয়ের অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তিনি।

এ ছাড়া একদিনে একটি সেমিনারে খরচ দেখানো হয় ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
নিয়োগ বাণিজ্যে বরাবরই পারদর্শী এবং বিতর্কিত ছিলেন বিদায়ী ভিসি ড. শিরীণ আখতার। শিক্ষক, কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতির ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ভিসির ব্যক্তিগত সহকারী (ডেপুটি রেজিস্ট্রার) খালেদ মিছবাহুল  মোকর রবিনের নামও চলে আসে। এ ছাড়া নিজের খেয়াল খুশিমত নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিল এই বিদায়ী ভিসির আমলে।

বাংলা ও আইন বিভাগে নিয়মবহির্ভূতভাবে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষক নেতারা। এ ছাড়া কিছুদিন পরপর ক্যাম্পাসে সংঘটিত ছাত্র সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে তিনি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তার মেয়াদে ৩শ’ বারেরও বেশি সংঘর্ষে জড়ায় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনগুলোর গ্রুপ-উপগ্রুপ। 
বিদায়ী ভিসির আমলে বলার মতো কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। এমনকি ছয়মাসের কাজ বাইশ মাসেও সম্পন্ন না হওয়ার নজির স্থাপিত হয়েছে। বন্ধ ছিল পূর্বে চালু হওয়া কিছু উন্নয়ন কার্যক্রম। সর্বোপরি এতবছর পরও বিশ^বিদ্যালয়ের কিছু বিভাগকে সেশনজটমুক্ত করা যায়নি। এরমধ্যে রয়েছে মেরিন সায়েন্সেস, আইইআর ও ইংরেজি বিভাগ। 
শেষ কর্মদিবসে ৫০ জনকে নিয়োগ ॥ বিদায় নেওয়ার শেষ কর্মদিবসে বিদায়ী ভিসি ড. শিরীণ আখতার মঙ্গলবার রাত ৩টা পর্যন্ত অফিস করেছেন। টানা এ সময়ে তিনি ৫০ জন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে গেছেন। যেহেতু এসব নিয়োগে কোনো বোর্ড গঠন করতে হয় না, সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিদায়ী ভিসি বিপুল অংকের অর্থ বাণিজ্যের মাধ্যমে এসব নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এক্ষেত্রে ভিসির ভাতিজা শাওন এবং কন্যা টিনা অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মাধ্যম হিসেবে যুক্ত ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, কোনো কোনো পদে ১৪ লাখ টাকা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ৬ লাখ টাকার নিচে কোনো নিয়োগ হয়নি। যারা ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। উচ্চমান, নি¤œমান এবং ঊর্ধ্বতন সহকারী পদে এসব নিয়োগে তার এপিএস সাহাব উদ্দিনও জড়িত ছিলেন বলে ক্যাম্পাসে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি উঠেছে। 
নতুন ভিসির দায়িত্ব গ্রহণ ॥ গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের নতুন ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ বিশ^বিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ড. মো. আবু তাহেরকে। বুধবার তিনি বিদায়ী ভিসির কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। মূলত তিনি এ বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। লিয়েনে তিনি নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য পদে। 
নতুন এ ভিসির সামনে রয়েছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। প্রথমত ছাত্র সংগঠনগুলোর টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করা, ছাত্র সংঘর্ষ বন্ধ করা, সর্বোপরি বিদায়ী ভিসির সব বিতর্কিত কর্মকা-ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। এর পাশাপাশি রয়েছে মেরিন সায়েন্স, আইইআর ও ইংরেজি বিভাগকে সেশনজটমুক্ত করা। 
বিশ^বিদ্যালয়ের মূল কাজের একটি হচ্ছে গবেষণা। কিন্তু বরাবরই এ বিষয়টি উপেক্ষিত হয়ে আসছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের দ্বারা। বিশ^বিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেটের খুব সামান্য অংশই গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। অথচ, একটি বিশ^বিদ্যালয় পরিচালিত হয় এর গবেষণা কর্মের দ্বারায়। সত্যিকার অর্থেই বিশ^বিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে হলে এ বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে। 

নতুন উপাচার্যেক ঘিরে শিক্ষার্থীরাও ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন। বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শাহ রিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ যেন বজায় থাকে। ক্যাম্পাসে কিছুদিন পরপর যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে উপাচার্যকে। 
নতুন উপাচার্য হিসেবে তিনি কোনো কাজগুলোকে প্রাধান্য দেবেন জানতে চাইলে উপাচার্য ড. তাহের বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার পরিসর বৃদ্ধি ও মানসম্মত গবেষণা যাতে হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করব। গবেষণা প্রজেক্টের জন্য ইউজিসির দিকে যাতে তাকিয়ে না থাকতে হয় সে ব্যবস্থা করব। গবেষণা থেকে  বিশ্ববিদ্যালয় যেন আয় করতে পারে তেমন কমার্শিয়াল রিসার্চের কাজ শুরু করব। এ ছাড়া চলমান বিভিন্ন প্রজেক্ট বাস্তবায়ন ও শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য একাডেমিক ক্যালেন্ডারের পূর্ণ অনুসরণের ওপরও জোর দেন তিনি।  
নতুন ভিসির প্রথম কার্যদিবসেই রেজিস্ট্রারকে শাসালো চবি ছাত্রলীগ ॥ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নতুন উপাচার্য ড. মো. আবু তাহেরের প্রথম কার্যদিবসেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমেদকে শাসিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একাংশের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এক ব্যক্তিকে মারধরও করেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগ করেনি এমন সকল নিয়োগপ্রাপ্তদের নিয়োগ বাতিল করতে বলেন। বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে। 
ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তির নাম ইয়াহিয়া টিপু। তাকে ৫৫০ টাকা দৈনিক মজুরির শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে কম্পিউটার ল্যাব সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যান সদ্য সাবেক ভিসি। 
টিপুকে মারধরের এক পর্যায়ে শাখা ছাত্রলীগের উপগ্রুপ বিজয়ের একাংশের নেতা ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ও ছাত্রলীগ করে না। তবুও ওরে চাকরি দিয়েছেন। ওর কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ খাইছে ভিসি ম্যাম।’
ঘটনার সময় রেজিস্ট্রার অফিসে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নাজেমুল আলম মুরাদ, মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন, আব্দুল মান্নান ও শঙ্কর বড়ুয়া। তাদের সামনেই এ ঘটনা ঘটায় ছাত্রলীগ। 
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কেএম নূর আহমেদ বলেন,  আমি তো কাউকে নিয়োগ দিতে পারি না। নিয়োগ দেন ভিসি। তবুও তারা আমার অফিসে এসে আমাকে অপমান করে গেলেন।

×