ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পদ্মার ওপর দিয়ে ট্রেনে ভাঙ্গা গেলেন প্রধানমন্ত্রী 

হুইসেলে আরেক স্বপ্ন পূরণ

কাওসার রহমান

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ১০ অক্টোবর ২০২৩

হুইসেলে আরেক স্বপ্ন পূরণ

এবার হুইসেলে আরেক স্বপ্ন পূরণ হলো দেশবাসীর

এবার হুইসেলে আরেক স্বপ্ন পূরণ হলো দেশবাসীর। প্রমত্ত পদ্মার ওপর দিয়ে গাড়ি চলবে এটাই কখনো কল্পনায় আসেনি। সেই পদ্মার ওপর দিয়ে গাড়ির পর এবার চলল ট্রেন। যে ট্রেনের হুইসেল বাজিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। দেখিয়েছেন ট্রেন চলাচলের সংকেত। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের সেই ‘ট্রেন’-ই ‘ঝক ঝক ঝক’ করে ছুটে চলল পদ্মার ওপর দিয়ে। তবে শেখ হাসিনার সেই ট্রেন পদ্মার ‘পুলের’ ওপর দিয়ে ‘ঝন ঝনাঝন ঝন’ শব্দে পৌঁছে গেল ফরিদপুরে। প্রমত্ত পদ্মায় সড়কের পর এবার সূচিত হলো রেল লাইনের।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে ডিজিটাল সুইচ টিপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা রেল সংযোগের উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন। পরে সেখানে দোয়া ও মোনাজাতে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিরা। এ সময় প্রধানমন্ত্রীকে পদ্মা রেল সেতুর রেপ্লিকা উপহার দেন প্রকল্প পরিচালক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা ও পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য দুপুর ১২টা ৫৩ মিনিটে মাওয়া স্টেশনের বুথ থেকে টিকিট কাটেন। মাওয়া স্টেশন থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত বিশেষ ট্রেনে ঢোকার আগে প্রধানমন্ত্রী সবুজ পতাকা নাড়ান ও বাঁশি বাজান। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও মন্ত্রিসভার সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে ট্রেনটি দুপুর ১টার সময় মাওয়া স্টেশন ছেড়ে যায়। 
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ট্রেনের জানালা দিয়ে পদ্মা সেতুর রূপ অবলোকন করেন। ট্রেনে বসেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ট্রেনের সংযোগটা হলো, পদ্মা সেতু আমরা নিজেদের অর্থায়নে করতে পেরেছি। যার ফলে আমরা বাংলাদেশের মানুষ; যাদের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না। বাংলাদেশের মানুষকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এর ফলে আমাদের আত্মবিশ্বাসটা এসেছে। এই পদ্মা সেতু নির্মাণে যারা শ্রম দিয়েছে, কাজ করেছে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর ধন্যবাদ জানাচ্ছি দেশের মানুষকে।’ প্রধানমন্ত্রী আল্লাহর কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 
পদ্মা সেতুর নিচের লেন দিয়ে যখন ট্রেন যাচ্ছিল, তখন তার ওপরের লেনে পাড়ি দেয় প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। রেলপথে স্বপ্নের পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ভাঙ্গা রেলস্টেশনের দিকে এগিয়ে যায় এই উদ্বোধনী ট্রেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ভাঙ্গা স্টেশনে ট্রেনটি দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে গিয়ে পৌঁছে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, তার উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্য, সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজনরা।
তবে বিশেষভাবে এই ট্রেনযাত্রায় বঙ্গবন্ধু কন্যার সফরসঙ্গী হিসেবে রিক্সাচালক, দিনমজুর থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ ছিলেন। অর্থাৎ ছোট বোন রেহানা, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাইরে আরও ৫০ জনকে সফরসঙ্গী হিসেবে নেন প্রধানমন্ত্রী। 
এদের মধ্যে ছিলেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা চারজন, প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রী চারজন, প্রাথমিক শিক্ষক একজন, মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রী তিনজন, ইমাম একজন, মাদ্রাসা শিক্ষক একজন, ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর দুইজন, হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী একজন, রিক্সাচালক একজন, কৃষক একজন, নারী কৃষক একজন, গার্মেন্টস শ্রমিক একজন, ফেরিচালক একজন, মাঝি একজন, মেট্রোরেল কন্ট্রোলার একজন, টিটিই একজন, ট্রেনচালক একজন, স্টেশন মাস্টার একজন, ওয়েম্যান একজন, বাসচালক একজন, হকার একজন, সবজি বিক্রেতা একজন, পাটকল শ্রমিক একজন, নার্স একজন, দিনমজুর একজন, জেলা আনসার ও ভিডিপি একজন, ভিডিপি একজন, পুলিশ একজন, ফায়ার সার্ভিসের একজন, স্কাউট একজন, বিএনসিসির একজন, র‌্যাব সদস্য একজন, রেল পুলিশ একজন, সেনাবাহিনী সদস্য একজন, নৌবাহিনীর সদস্য একজন, বিমান বাহিনীর সদস্য একজন, বিজিবি সদস্য একজন, কোস্ট গার্ড সদস্য একজন, আরএনবি সদস্য একজন। 
ভাঙ্গা স্টেশনে পৌঁছার পর আনুষ্ঠানিকতা সেরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান শেখ হাসিনা। জনসভা শেষে তিনি পিতৃভূমি গোপালগঞ্জে যান এবং সেখানে একদিন অবস্থান শেষে আজ বুধবার সড়ক পথে ঢাকায় ফিরবেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই সফর উপলক্ষে বিশেষ ট্রেনকে বর্ণিল কাগজ ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়। পদ্মা সেতুতে চলা উদ্বোধনী ট্রেনের লোকো মাস্টার (চালক) হিসেবে ছিলেন আবুল কাশেম। তার সঙ্গে ছিলেন লোকো মাস্টার আহসান উদ্দিন ও রবিউল ইসলাম।
প্রধানমন্ত্রীর ট্রেনের আগে একই সঙ্গে একটি ইঞ্জিন এগিয়ে যায়। এই ইঞ্জিনের লোকো মাস্টার ছিলেন আসলাম উদ্দিন খান। জরুরি প্রয়োজনে এই বাড়তি ইঞ্জিন নেওয়া হয়, যা একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা ট্রেনের সঙ্গে ছেড়ে যায়। 
উদ্বোধনী ট্রেন তাও আবার প্রধানমন্ত্রী সেই ট্রেনের যাত্রীÑ এমন ট্রেন চালাতে পেরে আনন্দে অভিভূত লোকো মাস্টার আবুল কাশেম। ট্রেন চালুর আগে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘রেলে ২০ বছর চাকরি করছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিন আর আসেনি, কখনো আসবে কি না জানি না। রেলে চাকরি জীবনে আমার স্বপ্ন পূরণের দিন আজ।’ 
তিনি বলেন, ‘আজ আমাদের আনন্দের দিন। স্বপ্ন পূরণের দিন। আমরা যারা রেলে কাজ করি, আমাদের স্বপ্নের দিন। কারণ আজ আমাদের ট্রেনে যাত্রী-সাধারণের সঙ্গে সফরসঙ্গী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’
অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই অনুভূতি আনন্দের, উৎসাহের। প্রধানমন্ত্রী আমাদের ট্রেনে যাচ্ছেন, এটাই আমার কাছে চাকরি জীবনে বড় প্রাপ্তি। এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না, আমরা গর্বিত। 
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রী যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, প্রথমে হবে কি হবে না, দ্বন্দ্ব ছিল। প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন বলেই সম্ভব হয়েছে।  
চাকরি জীবনে আর কোনো এমন স্মরণীয় ঘটনা রয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, না এত বড় স্মরণীয় ঘটনা ঘটেনি। আজ পূর্বের সব ঘটনাকে পেছনে ফেলে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে আমিই প্রথম পদ্মা সেতু দিয়ে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালিয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়েছি। মাওয়া থেকে গিয়েছি ভাঙ্গা স্টেশন পর্যন্ত। 
এর আগে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে আয়োজিত সুধীসমাবেশে উপস্থিত হয়ে এই রেলসংযোগ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে সড়ক যোগাযোগ চালুর ১৫ মাসের ব্যবধানে চালু হলো ট্রেন। এর মাধ্যমে দেশের মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরের মানুষ প্রথমবারের মতো রেল যোগাযোগের আওতায় এসেছে।

×