ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আইনজীবীদের আপত্তিকর জেরায় বিব্রত হন ধর্ষিতারা!

ধর্ষিতারা যে কারণে কোর্টে যেতে চায় না, পার পেয়ে যায় ধর্ষকরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭

ধর্ষিতারা যে কারণে কোর্টে যেতে চায় না, পার পেয়ে যায় ধর্ষকরা

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ২০০৮ সালে তামান্না (ছদ্মনাম) নিজ এলাকার একটি হোটেলে গণধর্ষণের শিকার হয়। পরবর্তীতে পুলিশী মামলার পর যখন সে বিচারের আশায় উৎসাহ প্রকাশ করে আদালতের শরণাপন্ন হলো তখনই মানসিকভাবে আরও নির্যাতিত হতে থাকল। কারণ আইনজীবীদের নানা আপত্তিকর প্রশ্নের মুখে সে জর্জরিত। বিরুদ্ধপক্ষের উকিলের মন্তব্য, ‘তিনি ধর্ষণের শিকার হননি। কারণ, তার আগে দু’বার বিয়ে হয়েছিল এবং সে যেকোন যৌনসম্পর্কে অভ্যস্ত।’ পরবর্তীতে তামান্না তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার পেল না এবং অপরাধীরাও বেঁচে গেল। শুধু তামান্না নয় বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলার বাদীরা ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে বিচার চাইলেই বিরুদ্ধপক্ষ তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, এমনকি চরিত্র হনন করতেও দ্বিধা করে না। বাদীকে মানসিকভাবে হেনস্তা করতেই মূলত প্রতিপক্ষ এমনটা করে থাকে। এমনকি ১৯৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারায় ওই নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ বলে আখ্যায়িত করার অনুমতি দিয়ে রাখা হয়েছে প্রতিপক্ষকে। আদালতে এভাবে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাহেঁচড়া দেখে অনেকেই বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। সওয়াল-জবাবের নামে আইনজীবীর ‘আপত্তিকর জেরা’ এড়াতে তাই ধর্ষিতাদের অনেকেই আদালতের দ্বারস্থ হতে চায় না। আর এজন্য অনেক ধর্ষণ মামলার বিচার সম্পন্ন হয় না আবার অনেক সময় অপরাধীপক্ষের কারণে ভীত হয়ে অনেক বাদী মামলা তুলে নিতে অথবা মীমাংসা করতে বাধ্য হয়। মানবাধিকার কর্মী এমনকি বিচারপতিরাও এই সাক্ষ্য আইনের বিশেষ ধারাটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এবং নারী অধিকার ও মানবাধিকারকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। বর্তমানে তা আদালতে চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় আছে। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৫ এর পিপি আলী আশগর স্বপন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচারের আশায় অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও আদালতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। আদালতের অনেক আইনজীবী ভিকটিমকে প্রশ্ন করে ‘আপনার কোথায় লেগেছে? আপনার সঙ্গে কি কি করা হয়েছে এবং কিভাবে? ইত্যাদি অশালীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে নির্যাতিত নারী পুনরায় আদালতে মানসিকভাবে নির্যাতিত হন।’ খসড়া নীতিমালায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার করণীয় হিসেবে বলা হয়েছে, ভিকটিম এবং তার পরিবার সম্পর্কে মর্যাদাহানিকর কোন অভিমত বা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ছবি তোলার কারণ বুঝিয়ে বলে ভিকটিমের সম্মতি নিয়ে ছবি তুলতে হবে। খসড়ায় আরও বলা হয়, ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার পর শারীরিক পরীক্ষা করতে ভিকটিম রাজি হলে তার সম্মতিপত্র পূরণ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। শারীরিক পরীক্ষার সময় ভিকটিমের সঙ্গে অবশ্যই নারী পুলিশ পাঠাতে হবে। নারী পুলিশ না থাকলে শিশুর অভিভাবক, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার বা বেসরকারী সংস্থার একজন নারী প্রতিনিধিকে পাঠাতে হবে। ডাক্তারী পরীক্ষার সময় ভুক্তভোগীর যথাযথ গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষা করার স্থানে গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক লুৎফা বেগম বলেন, ‘সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারা অভিযুক্তকে অব্যাহতি দিতে সাহায্য করে। অভিযোগকারীর চরিত্র কোন অবস্থাতেই ধর্ষণের অভিযোগ বিচারে বিচার্য বিষয় হওয়া কাম্য নয়। নীতিমালা হলে তা সঠিক পথ দেখাতে পারবে। তবে শুধু নীতিমালা দিয়েই সার্বিক পরিবেশের বদল ঘটানো সম্ভব নয়। তার মতে, এ ধরনের ঘটনার শিকার নারী-শিশুদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে এবং চিকিৎসক, পুলিশ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার যথাযথ দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ, প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে।’ এই খসড়া নীতিমালার প্রেক্ষাপটে রয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘টু ফিঙ্গার টেস্টে’র মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টি নিষিদ্ধকরণ। ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তথাকথিত ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ কেন আইনবহির্ভূত এবং অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা নিয়ে রুল দেয় হাইকোর্ট। দুই আঙ্গুলের মাধ্যমে ধর্ষণ পরীক্ষা পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, নারীপক্ষসহ দুই চিকিৎসক এই রিট আবেদনটি করেন। রুল দেয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা তৈরি করা হয়। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে (ভিকটিম) প্রথমে নিবন্ধিত চিকিৎসক, হাসপাতালে অথবা পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে। যেখানেই যাক, সেখান থেকেই আইনী পদক্ষেপ নেয়া শুরু করতে হবে।
×