ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাগরপথে বছরে ৫৩ হাজার মানুষ পাচার মালয়েশিয়ায়

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৪

সাগরপথে বছরে ৫৩ হাজার মানুষ পাচার মালয়েশিয়ায়

ফিরোজ মান্না ॥ চাকরির নামে চলছে বেপরোয়া মানব পাচার। বছরে ৫৩ হাজারের মতো মানব পাচার হচ্ছে। পাচারকারীরা মালয়েশিয়ায় চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে পাচার করে যাচ্ছে। দালালরা চক্র অন্য দেশেও ভাল চাকরির কথা বলে মানব পাচার করছে। মানব পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকার পরও দালালরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দালাল চক্রের কেউ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় মানব পাচার কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বেশিরভাগ পাচারের ঘটনা অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘটছে মালয়েশিয়ায়। অন্যান্য দেশেও হচ্ছে গোপনে। মালয়েশিয়ায় পাচারের রুট বেছে নেয়া হয়েছে সাগরপথে। মাঝে মধ্যে বর্ডার গার্ড, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, নৌবাহিনী অভিযান চালিয়ে ট্রলারসহ লোকজন আটকালেও দালাল চক্রের খুব কমই ধরা পড়ছে। এ জন্য পাচারের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। এ বছর জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় চাকরি নিয়ে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে প্রায় ৫৩ হাজার লোক সাগরপথে পাড়ি জমিয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক লোকের মধ্য থেকে ট্রলারডুবি, গরম ও দালাল চক্রের নির্যাতনে মারা গেছে ৫৪০ জন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাগরপথে পাড়ি জমানো ব্যক্তিদের বেশিরভাগই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়ের। রাষ্ট্রহীনের বোধ বা নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে তারা নানা দেশে ছুটছে। বাংলাদেশের লোকও উন্নত জীবনের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ সাগরপথে যাওয়া শুরু করে দালালদের প্রলোভনে। নৌকায় সাগরপথে পাড়ি জমাতে গিয়ে এই মানুষগুলোকে পানি, খাবার ও থাকার স্থানের সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়। পথে পাচারকারী অন্য কোন সশস্ত্র দলের সামনে পড়ে গেলে তা থেকে বাঁচতে যাত্রীদের কখনও কখনও সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে নৌকায় থাকতে হয়। ক্ষতি কাটিয়ে নিতে তখন অতিরিক্ত যাত্রী ওই নৌকায় তোলা হয়। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত মাইগ্রেশন রিসার্চ ইউনিট (রামরু) এক গবেষণায় নিরাপদ অভিবাসন ও প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে পুরনো আইনের পরিবর্তন চেয়েছে। রামরুর পক্ষ থেকে একটি অভিবাসন আইনের খসড়া তৈরি করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তাদের ওই খসড়া থেকে অনেক কিছু বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে দালাল চক্র পার পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দালাল চক্রের সঙ্গে সরকারের পুলিশ বাহিনী থেকে শুরু করে কয়েকটি সংস্থার ভাল যোগাযোগ রয়েছে। খসড়া আইনের ওপর সুশীল সমাজের মতামত নিয়ে মন্ত্রণালয় নিরাপদ অভিবাসন আইন করেছে। আইনটি এখনও পাস হয়নি। আইনটি পাস হলে অভিবাসন সমস্যা অর্ধেক কমে যাবে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ে অভিবাসীদের জন্য পাঁচটি দফতর খোলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনটি দফতর কাজ করে যাচ্ছে। এতে অবৈধ অভিবাসন হলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দফতরগুলোর সঙ্গে আরও কয়েকটি দফতর যোগ করা হলে অবৈধ অভিবাসন অনেক কমে যেত। রামরু সূত্র জানায়, তারা ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত অভিবাসন দশক হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী ঘোষণার কথাও বলেছে। আগামী জানুয়ারিতে ‘আবুধাবি প্রসেসিং’য়ে যোগ দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কারণ, সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিবাসন আইন ও অধিকার নিয়ে আলোচনা হবে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক দেশে অভিবাসন আইন যুগোপযোগী হয়নি। যেসব দেশ থেকে জনশক্তি রফতানি করা হয় তার মধ্যে বাংলাদেশীদের অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি। এর কারণ, ভিসা কেনা-বেচা। একটা ভিসা দুই-তিন হাত বদল হয়ে জনশক্তি রফতানিকারকদের হাতে এসে পৌঁছে। অথচ অন্য দেশগুলোতে বৈধপথে ভিসা আসে। তাদের লোকেরা কম খরচে বিদেশ যেতে পারে। এতে তাদের পুষিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের কর্মীরা ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে গিয়ে খরচ তুলতে পারে না। এ কারণে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তারা অবৈধ উপায়ে থেকে যায়। নানা বিপদ জানার পরও এমন এক পরিস্থিতিতে তাদের বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট এলিনা খান সম্প্রতি বলেছেন, প্রতিটি দেশের নিজস্ব অভিবাসন আইন আছে। আমাদের দেশে যে আইনটি রয়েছে সেটি খুব দুর্বল। এই আাইন দিয়ে প্রতারণা ঠেকানো যাবে না। মূল কথা হচ্ছে, যে সব দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার রয়েছে সেসব দেশে দূতাবাসকে সক্রিয় থাকতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, দূতাবাসের কর্মকর্তা যান নিজেদের ভোগ-বিলাসের জন্য। আর আমাদের কর্মীরা যান মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকা উপার্জন করতে। তাদের সুখ-দুঃখ দেখার সময় নেই দূতাবাসের কর্মকর্তাদের। যদি দূতাবাসগুলো সক্রিয় থাকত তাহলে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়ত। অকারণে অনেক প্রবাসীর দেশে ফিরতে হতো না। কারণে-অকারণে তাদের জেলবাসও করতে হতো না। ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পথে ৫৪০ মালয়েশিয়াগামী কর্মী মারা গেছেন। নৌকার মালিকপক্ষের লোকজনের মারধর, খাদ্য, পানি-সঙ্কট, অসুস্থতা ও গরমে তারা মারা যান। দালালরা প্রথমে খুব অল্প টাকায় থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায় যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নৌকায় তোলে। পরে পরিবার আরও অর্থ না দেয়া পর্যন্ত তাদের মাসের পর মাস আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। মানব পাচার করে দালালরা প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি ডলার আয় করে যাচ্ছে। এই টাকার একটি অংশ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছেও যাচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, অল্প পুঁজিতে যে কোন উপায়ে মালয়েশিয়া যেতে পারলেই হলো। এরপরই দালালদের লোভ দেখানো চাকরি পেলেই তো লাখপতি হওয়া যাবে। এমন স্বপ্নে অসহায় ও আর্থিকভাবে দুর্বল মানুষ তাদের অসচ্ছল পরিবারকে একটু স্বাবলম্বী করতে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নেয়। বৈধ পথে তাদের এই যাত্রা হয় না। সাগরপথে ট্রলারে যেতে হয়। চট্টগ্রাম ও মিয়ানমারের কিছু অসাধু মানব পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ার নামে প্রতিনিয়ত সাগরে নামছে হতদরিদ্র মানুষ। ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে টেকনাফ। এ পথে শত শত লোকের যাত্রা অব্যাহত রয়েছে। সংঘবদ্ধ চক্র সহজ সরল স্থানীয় ও বর্মী নাগরিকদের সঙ্গে মালয়েশিয়ার নামে প্রতারণা করে আসছে। পাচারকারী ও ট্রলার মাঝিরা অধিকাংশই বর্মী (মিয়নমার) নাগরিক। তারা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, উখিয়া, টেকনাফ উপকূলীয় এলাকা ব্যবহার করে পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই দালালরা বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বসে মানব পাচারের ব্যবসা করছে। সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়ে দুটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। গত ৭ নবেম্বর ১১০ যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়াগামী ট্রলার সাগরে ডুবে যায়। এতে নৌবাহিনী, বিজিবি ও কোস্টগার্ড ২৩ যাত্রীকে উদ্ধার করে। অর্ধশতাধিক লোক সাঁতরে ও মাছ ধরার নৌকায় কুলে ফিরে আসে। শাহপরীরদ্বীপ ও সাবরাং উপকূল থেকে দুটি লাশ পরে উদ্ধার হলেও আরও ৩৫ যাত্রীর ভাগ্যে কি ঘটেছে তার কোন হদিস নেই। উদ্ধারকৃত দুই লাশের মধ্যে একজনের পরিচয় মেললেও অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাছাড়া গত ২৭ অক্টোবর মালয়েশিয়াগামী ১৩৫ যাত্রী নিয়ে আরও একটি ট্রলার ডুবে যায়। ওই ট্রলারের ৬ যাত্রী উদ্ধার হলেও বাকি ১২৯ যাত্রীর হদিস মেলেনি। জানা গেছে, কয়েক বছর আগে টেকনাফ উপকূল দিয়ে কিছু লোক নিয়ে তাজর মুল্লুক নামের এক মাঝি সাগরপথে ট্রলারযোগে মালয়েশিয়ায় পাচারের পথ আবিষ্কার করেন। এ থেকে সাগর দিয়ে মানব পাচারের যে পথ তৈরি হয় তা এখনও অব্যাহত আছে। এ পাচার কাজে নিয়োজিত ২৫-৩০ ট্রলার মাঝি রয়েছে। শীতকালে দালালরা মানব পাচারের কাজটি বেশি করে। পুলিশ এই সময়টা বিভিন্ন পয়েন্টে ভালভাবে ব্যবস্থা নিলেই মানব পাচার অনেকাংশে কমে যেত। কিন্তু পুলিশ এই কাজটি সঠিকভাবে করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি সংস্থার নজর দাবি থাকলে পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ পর্যায়ে যেতে পারত না। পুলিশ এ পর্যন্ত ২৭ দালালকে আটক করতে পেরেছে। বাকি দালালরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
×