২০১৮ বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য সবার কাছ থেকেই প্রশংসা কুড়িয়েছে রাশিয়া। আয়োজনের কোথাও কোন কমতি ছিল না, বিদেশী দর্শকদের জন্যও ছিল কড়া নিরাপত্তা। বেশি খুঁতখুঁতে মেজাজের না হলে কারও পক্ষে রাশিয়ানদের আয়োজনের কোন ত্রুটি ধরা সম্ভব না। জমকালো স্টেডিয়াম, স্টেডিয়ামে বিনা মূল্যে ট্রেনযাত্রার ব্যবস্থা, সমর্থকদের মধ্যেও কোন দাঙ্গা দেখা যায়নি। রাশিয়া এখন যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ। শুধু বিদেশী পর্যটকদেরই নয় খেলোয়াড়দেরও মন কেড়েছেন পুতিন। সাবেক জার্মান মিডফিল্ডার লোথার ম্যাথাউসের মতে, ‘গত চল্লিশ বছরে যত আমি যতগুলো বিশ্বকাপ দেখেছি তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা বিশ্বকাপ ছিল এটি। সত্যি অনন্য আয়োজন। ধন্যবাদ রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট, ধন্যবাদ রাশিয়া।’ কূটনীতিক সম্পর্কটা যে এই বিশ্বকাপের জেরেই অনেকটা মসৃণ হয়েছে তা না বললেও চলে। বিশ্বকাপটা জিতল আসলে রাশিয়াই।
কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে রাশিয়া বিশ্বকাপ বয়কটের হুমকি দিয়েছিল ইংল্যান্ড। একনায়কতন্ত্রের প্রসঙ্গ টেনে ইউরোপ-আমেরিকার প্রভাশালী অনেক দেশই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ক্রীড়া আসরের সফলতা নিয়ে ছিল সন্দিহান। রুশদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়েও প্রপাগা-া চালিয়েছিল অনেক সংগঠন। কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছিলেন, মাঠের খেলায় না হলেও আয়োজনের বিচারে বিশ্বকাপ জয় করতে চায় তার দেশ। সেটিই সত্যি হয়েছে। ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর মতে, এটাই ইতিহাসের সেরা বিশ্বকাপ। ১৪ জুন থেকে ১৫ জুলাই’ ১৮Ñ ৩২ দিনের আয়োজন, আতিথেয়তায় গোটা বিশ্বকে মোহিত করে রাখে রাশিয়া। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে রাশানদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুরুতেই বড় দল ও বড় তারকার পতন, ছোট দলগুলোর উত্থানÑ মাঠের দ্বৈরথেও রাশিয়া বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম চমক হয়ে থাকবে।
ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো বলেন, ‘২০১৮ বিশ্বকাপ প্রমাণ করেছে সত্যিই রাশিয়া ফুটবলের দেশ। ইতিহাসের সেরা আয়োজন করেছে তারা। দর্শক মাতিয়েছে এ আসর। আর তাই সবার মুখে মুখে এখন শুধু- রাশিয়া, রাশিয়া, রাশিয়া!’ তিনি এও বলেন, ‘আমি আগেই জানতাম রাশিয়া ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এখন আরও জোর দিয়ে বলছি, ফিফায় রাশিয়া রেকর্ড গড়েছে।’ এদিকে, গোটা বিশ্বের অজস্র প্রশংসা পাওয়ায় তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøালাদিমির পুতিন। প্রভাবশালী এ প্রেসিডেন্ট বলেন, সমর্থকরা দুর্দান্ত খেলা উপভোগ করেছেন। এর জন্য তারা অনেক খুশি। সে জন্য আমাদের আয়োজনকারীদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করায় আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা অনেক খুশি। এতবড় একটি আয়োজনে সফল হয়েছি। দর্শকরা আমাদের দেশে এসে খেলা দেখেছেন। তারা আমাদের আতিথেয়তা এবং উন্মুক্ততা, প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পছন্দ করেছেন। তারা অনুভব করতে পেরেছেন আমরা খুব ভাল আয়োজন করেছি। এ জন্যই তারা অনেক প্রশংসা করছেন।’
দেশটার নাম রাশিয়া বলেই ডোপিং নিয়ে তাদের ভূমিকায় অধিকাংশ দেশ ছিল প্রবল ধোঁয়াশায়। দোসর ছিল পশ্চিমী দুনিয়ার ধারাবাহিক নেতিবাচক প্রচার। ঝড়-ঝাপটা সামলে রাশিয়া দেখিয়েছে এত বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন কার্যত বিতর্কহীন, ব্যতিক্রম, মনে রাখার মতো। মাঠে যাই হোক মাঠের বাইরে তিনিই আসল রাজা। সেটি রাশিয়ায় আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন জীবন্ত কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোন। কখনও নাইজেরীয় সমর্থকদের উদ্দেশে অশ্লীল অঙ্গিভঙ্গি, গ্যালারিতে চুরুট ধরানো, আর্জেন্টিনার কোচ হতে চাওয়া। বিতর্কে মানেই ফুটবলের রাজপুত্র। ফিফার এ্যাম্বাসেডর হয়েও কলম্বিয়া ম্যাচে রেফারির ভূমিকায় তিনি সরব হন। টুর্নামেন্টের শেষ পথে ফিফা জানিয়ে দেয় রাশিয়া বিশ্বকাপ ডোপমুক্ত। বিশ্বকাপের আয়োজনে দেশের অর্থনীতি আরও মজুবত করতে পেরেছে পুতিন প্রশাসন। বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রজনিকে বাছায় মিসরের ওপর বিরক্ত ছিল রাশিয়া। ট্রেনিংয়ের মহম্মদ সালাহর সঙ্গে এক চেচেন নেতার ছবিতে বিতর্ক আরও বাড়ে।
সার্বিয়ার বিরুদ্ধে গোল করে জাদরান শাকিরি ও জাকার বিতর্কিত সেলিব্রেশনের জল গড়ায় ফিফা পর্যন্ত। দুই ফুটবলার আলবেনিয়াকে সমর্থনের ইঙ্গিত করেন। জরিমানা করে তাদের রেহাই দেয় ফিফা। ইউক্রেনের হয়ে গলা ফাটিয়ে সমালোচিত হন ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডার ভিদা। পরে অবশ্য তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন। ক্রোয়েট ফুটবলারদের সঙ্গে ছবি পোস্ট এবং সমর্থন করে সমালোচিত হন সার্বিয়ার টেনিস তারকা নোভাক জোকোভিচ। আর মাঠের কথা বলতে গেলে সবার আগে নাম আসবে রাশিয়ার। বিশ্বকাপে খেলা ৩২টি দেশের মধ্যে সব থেকে পেছনের র্যাঙ্ক ছিল আয়োজকদের। অথচ তারাই দুনিয়াকে অবাক করে শেষ আটে উঠে যায়। ৪২ লাখের দেশ ক্রোয়েশিয়ার উত্থানও বিশ্ববাসীকে রীতিমতো চমকে দেয়। সোনালি প্রজন্মের বেলজিয়ামের তৃতীয় স্থান দখল অন্যতম আলোচিত ইস্যু। এই প্রথম কোন বিশ্বকাপে গোল-কার্ডের জন্য প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া হয়। ভিডিও রেফারিং সিস্টেম চালু হওয়ায় রেফারিরা অনেকটাই নির্ঝঞ্ঝাট ছিলেন। এবারই প্রথম এক্সটা টাইমে চতুর্থ ফুটবলার নামানোর অনুমতি দেয় ফিফা।
অঘটনের ভেন্যু হিসেবে কাজানের কথা না বললেই নয়। কাজান নামটা অভিশপ্ত এবার একাধিক টিমের কাছে। জার্মানি থেকে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল। এই স্টেডিয়াম ছুটি করে দিয়েছে হট-ফেবারিট সব টিমগুলোকে। প্রথম ম্যাচে মেসির আর্জেন্টিনাকে আটকে দিয়েছিল নবাগত আইসল্যান্ড। তবে শেষরক্ষা হয়নি। বিশ্বকাপের অভিষেকে প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে যায় তারা। অস্তমিত তারার শুরটা ছিল মোহাম্মদ সালাহকে দিয়ে। তারপর লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, নেইমার। কার্যত কোয়ার্টারের আগেই বিশ্বকাপের তারকারা উধাও হয়ে যায়। এরই মধ্যে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপের তারিখ চূড়ান্ত করেছে ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। যার মাধ্যমে ভাঙতে যাচ্ছে বিশ্বকাপের জন্য ঐতিহ্যগতভাবে নির্ধারিত জুন-জুলাই সময় অর্থাৎ গ্রীষ্ম মৌসুম। ফিফা জানিয়েছে, বিশ্বকাপের ২০২২ সংস্করণ মাঠে গড়াবে নবেম্বরের ২১ তারিখ, যা এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে কোন দলের ‘বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তকমায়’ পর্দা নামবে।
তবে কাতার বিশ্বকাপে কয়টি দল অংশ নিবে তা নিশ্চিত হয়নি। কারণ এরইমধ্যে গুঞ্জন উঠেছে কাতার বিশ্বকাপের অংশ নিচ্ছে ৪৮ দল। এ বিষয়ে ইনফান্তিনো বলেন, ‘আগামী বিশ্বকাপে ৩২টি দলের ফরমেট নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। তবে বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনার ‘জায়গা’ রয়েছে।’ ঘটন-অঘটনের এবারের বিশ্বকাপকেই নির্দ্বিধায় সবচেয়ে বেশি ‘আকর্ষণীয়’ কলে আখ্যা দিয়েছেন ফিফা প্রধান। মস্কো, ১৫ই জুলাই ফাইনালের আগে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ফুটবল তুলে দেন পুতিন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। মস্কোর ওই অনুষ্ঠানে কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানি উপস্থিত ছিলেন। আর দুজনের মাঝে ছিলেন ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। ‘রাশিয়া সফলভাবে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছে। এমন একটি টুর্নামেন্ট করতে পেরে গর্বিত। আমি এখন ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য কাতারকে আহ্বান জানাচ্ছি। বিশ্বকাপ শেষ হচ্ছে। তবে আমাদের ভাল লাগছে। সমর্থকরা উৎসব করেছেন। আশা করি কাতারেও এমন একটি বিশ্বকাপ হবে। আশা করব কাতারও ২০২২ সালে একইরকম সাফল্য পাবে। আমার বন্ধুর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।’ আরবের প্রথম দেশ হিসাবে কাতার বিশ্বকাপের আয়োজন করতে চলেছে। পুতিন তার বক্ত্যবে আরও বলেন, আমরা যেমন করেছি, কাতারও সেখানে সফল হবে বলে আমি মনে করি। এই বিশ্বকাপ আমরা কিভাবে করেছি সে ব্যাপারে কাতারকে সাহায্য করব। আমরা সাহায্য করতে পারলে ব্যাপারটি আরও ভাল হবে। ফুটবল বিশ্বকাপ মহাদেশ ও মানুষের মধ্যে যে ভালবাসা সৃষ্টি করেছে সেটা নজির হিসেবে থাকবে। স্প্যাসিভা (ধন্যবাদ।)!
শীর্ষ সংবাদ: