ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বিদ্যুৎ-জ্বালানির ভর্তুকি তুলে দিতে ১৩ দাবি 

দাম না বাড়িয়েও ভর্তুকি কমানো যায় : ক্যাব

প্রকাশিত: ১৭:৫৩, ২ মে ২০২৪

দাম না বাড়িয়েও ভর্তুকি কমানো যায় : ক্যাব

সংবাদ সম্মেলন

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত মোতাবেক কিছু দিন পর পরই দেশে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি নাও করে আগামী তিন বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে দাবি করেছে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। এ লক্ষ্যে সংগঠনটি ১৩ দফা দাবি জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি হলে ক্যাব আয়োজিত ‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা সুরক্ষায় মূল্যবৃদ্ধি নয়, জ্বালানি সুবিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে এসব দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, গত ২৫ এপ্রিল ঋণ কর্মসূচির আওতাযয়পর্যবেক্ষণে আসা আইএমএফের প্রতিনিধি দল অর্থ বিভাগের বাজেট অনু বিভাগের সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারে ভর্তুকি উঠিয়ে দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যয় সমন্বয়ের সুপারিশ করেছে। ভর্তুকির অর্থ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রমে খরচ করার পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগ বলেছে খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়টি মাথায় রেখে আপাতত কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেবে সরকার। এতে করে বোঝা যায়, জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের মাথায় নেই। তারা কি বোঝেনা, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না? আমরা মনে করি জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি না করে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা সম্ভব।

তিনি আরো বলেন, ভোক্তা যেন সঠিক দাম, মাপ ও মানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সেবা পায়, সেজন্য মূল্যহার নির্ধারণসহ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, সমতা, যৌক্তিকতা ও জবাবদিহিতা তথা জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ২৯ এপ্রিল ক্যাব ভোক্তাদের পক্ষ থেকে এক সংস্কার প্রস্তাব প্রকাশ করে। সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমরা ১৩ দফা দাবি জানাচ্ছি। 

লিখিত বক্তব্যে এম শামসুল আলম আরও বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক সুরক্ষার জন্য দেশে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাই ভোক্তাদের অধিকার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ভর্তুকি কমানোর শর্তের অজুহাতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম না বাড়িয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইন ২০১০ এর আওতায় প্রতিযোগিতাহীন ব্যক্তিখাত বিনিয়োগে খাতটির উন্নয়ন অব্যাহত আছে। তাতে বিনিয়োগকারীরা খেয়াল-খুশি মতো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বাড়িয়ে লুণ্ঠনমূলক মুনাফার সুযোগ নিচ্ছে। ফলে আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বাড়ছে। আর তা সমন্বয়ে মূল্য ও ভর্তুকি উভয় বাড়ছে। ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

সরকার এখন ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণের জন্য দিশেহারা হয়ে আইএমএফের পেছনে দৌড়াচ্ছে উল্লেখ করে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা আরও বলেন, জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণ তথা জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন আর সরকারের জন্য ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ভোক্তারা চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ‘অসাধু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসায় লাগাম দিন, মূল্য বৃদ্ধি থেকে সরে আসুন- মানুষকে অভয় দিন।’

এ সময়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এজাজ হোসাইন বলেন, সরকার যে দাম বাড়াবে (বিদ্যুৎ-জ্বালানীর), সেটা আমি দেবো। কিন্তু তার মধ্যে যে চুরি ও অপচয় রয়েছে, তার দায় কেন আমি নেবো? জ্বালানি নেই, তবুও পাওয়ার প্ল্যান্ট করা হচ্ছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কেন অনিয়মের খোঁজ নেয় না। বাংলাদেশে এখনো ৩০ শতাংশ ফার্নেস অয়েল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের কোথাও ৫ শতাংশের বেশি নেই। এসব বিষয়ে দাতা সংস্থাগুলো কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
তিনি বলেন, ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র েেক লাভ কি, যদি উৎপাদন না করা যায়। আমি মনে করি, দেশে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেই যথেষ্ট। কারণ এর বেশি তো আর দেশে উৎপাদন হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়। বাকি সময়ে ১২-১৩ হাজার মেগাওয়াট’ই উৎপাদন হয়। তাহলে বাড়তি অপচয়ের বিষয়ে আইএমএফ কেন দেখছে না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি একটি স্টেটেটিক পণ্য বা সেবা। তাই নোটিশের মাধ্যমে এই মূল্য বৃদ্ধি গ্রহণ যোগ্য নয়। এটা বিইআরসির গণশুনানির মাধ্যমে মাধ্যমে হবে, আর সেটাই কাম্য। কিন্তু নির্বাহী আদেশে বিইআরসির শক্তিকে খর্ব করে রাখা হয়েছে। এখন বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম বাড়ছে নির্বাহী আদেশে। এর মাধ্যমে অধিকার হারাচ্ছে জনগণ।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক সামসুল হুদা বলেন, বিশ্বের কোন দেশ আইএমএফের শর্তে ঋণ নিয়ে উন্নতি করেছে, এমন নজির কোথাও নেই। আর এ বিষয়ে সরকারকে নজর রাখা দরকার। তাই তাদের শর্তের বেড়াজালে-দেশকে বিপদে ফেলবেন না। কারণ তাদের শর্ত জনগণের স্বার্থে নয়।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আইএমএফ বলেছে মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে ভর্তুকি কমানোর। কিন্তু এটা যুক্তি সঙ্গত নয়। এটা সুবিচারও নয়। তাই আমরা আইএমএফকে বলবো- (দাম বাড়ানোর শর্ত না দিয়ে) কোথায় অসঙ্গতি আছে, সেটা খুঁজে বের করতে। তিনি বলেন, জ্বালানি খাতে সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে। কিন্তু যথা সময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে বা অনিহা রয়েছে। ফলে তার দায়ভার নিতে হচ্ছে ভোক্তাকে। আইএমএফের পরামর্শে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি না করে বরং জ্বালানি খাতের অপচয় রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে মূল্য বৃদ্ধি না করেই ভর্তুকি কমানো সম্ভব।

সংবাদ সম্মেলনে, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি না করে ৩ বছরের মধ্যে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ক্যাবের পক্ষ থেকে তুলে ধরা ১৩ দফা দাবিগুলো হলো, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতাবিহীন যে কোনো ধরনের বিনিয়োগ আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করতে হবে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০১০ রদ করতে হবে। এবং ২০০৩ সালের বাংলাদেশ  রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইনের সংযোজিত ধারা সংশোধনক্রমে ৩৪ এর ‘ক' ধারা রোহিত হতে হবে,  গ্যাস উন্নয়ন তহবিল, বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল ও জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিলের অর্থ যথাক্রমে বাপেক্সের গ্যাস অনুসন্ধান, পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জ্বালানি আমদানিতে ঋণ নয় ভোক্তার ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হতে হবে, মুনাফা ব্যতীত কস্ট বেসিসে ৫০ শতাংশের অধিক বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদন সরকারের একক মালিকানায় হতে হবে। কস্ট প্লাস নয়, সরকার শুধু কস্ট বেসিসে বিদ্যুৎ-জ্বালানি সেবা দেবে, প্রাথমিক জ্বালানি মিশ্রণে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনায় এলএনজি, কয়লা ও তেলের অনুপাত কমাতে হবে। নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও মজুদ বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানি নিয়ন্ত্রণে রেখে আমদানি ব্যয় কমাতে হবে, সরকার ব্যক্তি খাতের সঙ্গে যৌথ মালিকানায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত হবে না এবং মালিকানাধীন কোম্পানির শেয়ার ব্যক্তি খাতে হস্তান্তর করবে না তা আইন দ্বারা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয় তেল শোধনাগার এস আলম গ্রুপের সঙ্গে নয়, সরকারের একক মালিকানায় হতে হবে,  বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতভুক্ত সরকারি ও যৌথ মালিকানাধীন সকল কোম্পানির বোর্ড থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের সকল আমলাদের প্রত্যাহার করতে হবে, নিজস্ব কারিগরি জনবল দ্বারা স্বাধীনভাবে উভয় খাতের  কোম্পানি বা সংস্থাসমূহের কার্যক্রম পরিচালিত হতে হবে। সেক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় শুধু বিধি ও নীতি প্রণয়ন, এবং আইন বিধি-প্রবিধান অনুসরণ ও রেগুলেটরি আদেশগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনিক নজরদারি ও সনদধারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। আর রেগুলেটর হিসেবে বিইআরসিকে সক্রিয় স্বাধীন নিরপেক্ষ হতে হবে, জলবায়ু তহবিলসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নয় ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত হতে হবে। এবং সে ক্ষতিপূরণ ক্ষতিগ্রস্থদের সক্ষমতা উন্নয়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাজার সম্প্রসারণে আইন করে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, বিদ্যুৎ জীবাশ্ম নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন নীতি আইন বিধি-বিধান ও পরিকল্পনা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্পাদিত প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উন্নয়নে সকল চুক্তি আইনি প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত মডেল চুক্তি মত হতে হবে। বাপেক্স ও সান্তোসয়ের মধ্যে মগনামা-২ অনুসন্ধান কূপ খননে সম্পাদিত সম্পূরক চুক্তি, আরইবি ও সামিট পাওয়ারয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি, পিডিবি ও সামিট পাওয়ারের মধ্যে মেঘনাঘাট পাওয়ার প্লান্ট এর বিদ্যুৎ ক্রয় সম্পূরক চুক্তি, পিডিবি আদানির মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিসহ সবগুলো জনস্বার্থ বিরোধী চুক্তি বাতিল করতে হবে। ১৯৯৪ সালের জ্বালানি সনদ চুক্তি স্বাক্ষরে সরকারকে বিরত থাকতে হবে এছাড়া, জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষার লক্ষ্যে বিদ্যুতে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য এনার্জি প্রাইস স্ট্যাবিলাইজড ফান্ড গঠন করতে হবে।
 

 

স্বপ্না

×