ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে জর্জ বাহিনী

একাত্তরের মার্চে প্রত্যেক বাঙালি সাহসী সৈনিক হয়ে উঠেছিলেন

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০০:৩৭, ১৯ মার্চ ২০২৪

একাত্তরের মার্চে প্রত্যেক বাঙালি সাহসী সৈনিক হয়ে উঠেছিলেন

উত্তাল মার্চে দিনাজপুরের রাস্তায় পাকি সেনাদের প্রতিরোধে বাঙালি ইপিআর

স্বাধীনতা সংগ্রামে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন ইপিআর বাহিনীর বাঙালি সৈনিকরা (বর্তমানে বিজিবি) বঙ্গবন্ধুর ডাকে পাকি সেনাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সারা দেশের মতো উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে এ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ, গেরিলা যুদ্ধ ও শত্রুঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করতে আত্মঘাতী আক্রমণসহ অসংখ্য দুর্ধর্ষ অপারেশন পরিচালনা করেছিলেন।

উত্তরাঞ্চলের উত্তাল মার্চে দিনাজপুরের বাঙালি ইপিআর সদস্যদের কুঠিবাড়ী বিদ্রোহের অজানা অনেক কথা রয়ে গেছে। বিশেষ করে দিনাজপুরের কুঠিবাড়ীর বাঙালি ইপিআর সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শত প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে তাঁরা সেদিন যে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। কুঠিবাড়ীর বিদ্রোহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। 
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম শামসুদ্দিনের ডায়েরির পাতায় উঠে এসেছে দিনাজপুরের কুঠিবাড়ীর বাঙালি ইপিআর সদস্যরা স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মৃতি । ১৯৭১ সালে ইপিআরের সেক্টর সদর দপ্তর ছিল দিনাজপুরের কুঠিবাড়ীতে। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এই কুঠিবাড়ী ব্যারাক থেকেই। দিনাজপুরে তিনটি উইং ছিল। ৮ নম্বর উইং ছিল দিনাজপুরে, ৯ নম্বর উইং ছিল ঠাকুরগাঁওয়ে এবং ১০ নম্বর উইং ছিল রংপুরে।

সেক্টর কমান্ডার ও সব উইংয়ের কমান্ডার ছিলেন অবাঙালি অফিসার। মেডিক্যাল অফিসারসহ মাত্র তিনজন বাঙালি অফিসার ছিলেন দিনাজপুর সেক্টর সদর দপ্তরে। সুবেদার মেজরসহ ৩০০ বাঙালি সৈনিকও ছিল সদর দপ্তরে। ২৮ মার্চ আনুমানিক ১১টায় ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কো¤পানির এক বাঙালি ওয়্যারলেস অপারেটর সেক্টর সদর দপ্তরের বাঙালি হাবিলদার ভুলু মিয়াকে বলেন, আজ পাকিস্তানি সৈন্যরা ইপিআর সেক্টরে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে।

এ কারণেই আমাদের ওপর আদেশ হয়েছে, সব ওয়্যারলেস সেটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার। ২৬ ফ্রন্টিয়ারের সৈনিকটির এই গোপন সংবাদ বিদ্যুৎগতিতে সেক্টর সদর দপ্তরের বাঙালি সদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই মানসিক প্রস্তুতি নেন। হাবিলদার আবু সাঈদ এ দিন আরও বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে বিতরণ করেন।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে অবাঙালি জোয়ানরা কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড গোলাগুলির মাধ্যমে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা ক্যা¤প দখল করে নেন এবং ক্যা¤েপ অবস্থিত অবাঙালি সদস্যদের হত্যা করেন। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করার পরপরই দিনাজপুর সার্কিট হাউস থেকে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স কুঠিবাড়ীর ওপর ভারী গুলিবর্ষণ শুরু করেন। আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মর্টার প্লাটুনের মর্টারসহ বাঙালি ইপিআর সদস্যরা কুঠিবাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাঞ্চন নদীর তীরে প্রতিরক্ষায় অবস্থান নেন।

এ ছাড়া অন্যান্য বাঙালি সদস্য ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট লঞ্চার, এলএমজি নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় চলে যান। পাকিস্তানিদের সঙ্গে যখন যুদ্ধ বেধে যায়, তখন অনেক বাঙালি সৈনিক অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ডিউটিতে শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছিলেন। আক্রমণের খবর পেয়ে তাঁরা সেক্টর সদর দপ্তরে ফিরে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। এ সময় হাবিলদার মুসলিম সেক্টর সদর দপ্তরের বাইরে গিয়ে জনতার সাহায্য চাইলে অনেক তরুণ-যুবাও তাঁদের সঙ্গে এসে যোগ দেন।

মার্চের প্রথম থেকেই দিনাজপুরের পাবলিক লাইব্রেরি ও হাইস্কুলের মাঠে ছাত্র-শিক্ষক, যুবকসহ বিভিন্ন শ্রেণির আনুমানিক ২০০-৩০০ তরুণ ইউওটিসি ক্যাডেটদের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নেন। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন, যাতে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা বিদ্রোহ করলে সংগ্রামী জনতা তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়।

এ সময় অস্ত্রাগার থেকে প্রচুর ভারী ও হালকা অস্ত্র বের করে কাঞ্চন নদীর তীরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। অসীম সাহসী ও বলিষ্ঠ মানসিকতার অধিকারী হাবিলদার ভুলু মিয়া এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। অবাঙালি সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক রসুল কোরেশী দিনাজপুর শহরের নিরাপত্তা ডিউটির জন্য ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের অফিসারদের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য ২৮ মার্চ বিকেল চারটায় কনফারেন্সের নামে বাঙালি অফিসারদের সার্কিট হাউসে ডেকে পাঠান, যাতে কুঠিবাড়ীতে অবস্থিত বাঙালি ইপিআর সদস্যদের নেতৃত্ব দিতে না পারেন।

সুবেদার মেজর আব্দুর রব ২৯ মার্চ বাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেন। যোগ দিয়েই তিনি চাপসার, বিরল, কামদেবপুর ও অন্যান্য বিওপিতে অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে কাঞ্চন নদীর তীরে প্রতিরক্ষা অবস্থানে চলে আসার জন্য বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের নির্দেশ দেন। ওদিকে ৮ নম্বর উইংয়ের বাসুদেবপুরে কো¤পানি কমান্ডার সুবেদার এম এ শুকুর মিয়া তাঁর ১ নম্বর প্লাটুন পুলহাট ও ২ নম্বর প্লাটুনকে ফুলবাড়ীর পাকা রাস্তার উভয় পাশে সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে দিনাজপুরমুখী শক্রর চলমান কনভয়ের ওপর অ্যামবুশ করার জন্য অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন।

সুবেদার শুকুর মিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনা একেবারে বৃথা যায়নি। সৈয়দপুর থেকে আসা পাকিস্তানি সৈনিকেরা দিনাজপুরে অবস্থিত তাদের সহযোগিতার জন্য দিনাজপুরের দিক অগ্রসর হলে সুবেদার শুকুর মিয়ার পাতা ফাঁদে আটকা পড়ে। পাকিস্তানি কনভয় সুবেদার শুকুর মিয়ার অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশ করলে অ্যামবুশ পার্টি প্রচ- ফায়ার শুরু করে। রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত বাঙালি ইপিআর সদস্যদের শক্রর সঙ্গে গুলিবিনিময় হয়। এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈনিকেরা চূড়ান্তভাবে মার খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

অবশেষে তারা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নীলফামারীর সৈয়দপুর সেনানিবাসে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈনিকেরা সেক্টর সদর দপ্তরের ওপর গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখে। কিন্তু বাঙালি সদস্যদের পাল্টা গোলার আঘাতে টিকতে না পেরে সার্কিট হাউস এলাকা থেকে সরে গিয়ে দিনাজপুরের চেহেলগাজী মাজার হয়ে ঘুঘুডাঙার দিকে অগ্রসর হয়। তারা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পেছনে কাঞ্চন জংশনের কাছে রিয়ার হেডকোয়ার্টার্স দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইপিআরের বাঙালি সদস্য ও সংগ্রামী জনতার মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের ফলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

×