ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

আট হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা জানে না কেউ

হ য ব র ল ॥ মাদ্রাসা শিক্ষায়

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৪ জুন ২০২৩

হ য ব র ল ॥ মাদ্রাসা শিক্ষায়

শিক্ষকের মান নিয়ে সংশয়, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকা ও দাপ্তরিক সমন্বয়ের অভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা

শিক্ষকের মান নিয়ে সংশয়, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকা ও দাপ্তরিক সমন্বয়ের অভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা হযবরল অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েছে। দেশের আট হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় কত শিক্ষার্থী আছে, সে তথ্যও নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মাদ্রাসা শিক্ষায় যুক্ত হয়েও দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হতে পারছে না। এরফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় এই শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময় উপযোগী প্রদক্ষেপ মুখে মুখে নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে দিন দিন এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষার্থীরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
চলতি বছর দাখিল (মাধ্যমিক) পরীক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে ২ লাখ ৯৫ হাজার শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অথচ এই শিক্ষা বোর্ড থেকেই নিবন্ধন করেছিল সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থী। একই বোর্ড থেকে গত আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ৮৪ হাজার পরীক্ষার্থী। বোর্ড সূত্র বলছে, দাখিলে যেসব পরীক্ষার্থী অংশ তার ৭৫ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। যা দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে এসব শিক্ষার্থী কোথায় যায়, কি পড়ে, কোথায় চাকরি করে নেয় তা নিয়ে কোন গবেষণা না থাকায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জনকণ্ঠকে কোন জবাব দিতে পারেননি।
সমন্বয়ের অভাবে বিশৃঙ্খলা ॥ সরকারি প্রাথমিক থেকে কিন্ডারগার্টেন প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হলেও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাথমিক স্তর ইবতেদায়ি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে।

অন্যদিকে দাখিল ও আলিম শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসা বোর্ডের আওতায়। এসব পর্যায়ের ভোকেশনাল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে। অন্যদিকে ফাজিল ও কামিল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দেখভাল করে ইসলামী আরবি বিশ^বিদ্যালয়। এর বাইরে কওমী মাদ্রাসার বিরাট একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে বেফাক। যা আবার দ্বিখ-িত। এসব কারণে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় সমন্বয়ের ঘাটতি প্রবল। এ ছাড়া কারিকুলাম ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে কাজ করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, কারিগরি অধিদপ্তরের আওতায় মাত্র ২৫০টি মাদ্রাসায় ভোকেশনাল চলছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোর অভাব রয়েছে এসব মাদ্রাসায়। এর ফলে প্রকৃত অর্থে এই শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা নৈপূণ্য দেখাতে পারছে না। বেফাকের সঙ্গে আলোচনা করতে একাধিকবার কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানকেও মাদ্রাসা বোর্ড থেকে চিঠি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। তবে প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করেছে বেফাক।

এ বিষয়ে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের জনসংযোগ শাখার মুখপাত্র অসিউর রহমান শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ও মাদ্রাসার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। বিস্তারিত তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে বলে জানান। তবে ওয়েবসাইটে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইবতেদায়ি শিক্ষার্থীদের কেউ নিতে চায় না ॥ মাদ্রাসায় প্রাথমিকের জন্য যে স্তর তাকে ইবতেদায়ি বলা হয়। প্রাথমিক স্তরে এসব শিশু এখানে পড়াশুনা করলেও এর দায়িত্ব প্রাথমিক মন্ত্রণালয়ের নয়। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগও এদের একাডেমিক বিষয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এর ফলে এই পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যেমন একদিক দিয়ে সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে ভালো পড়াশুনার সুযোগও পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (প্রাথমিক) অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ইবতেদায়িকে বারবার প্রাথমিকের অধীনে দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু অধিদপ্তর তাদের নিতে রাজি নয়। এ বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। এর ফলে এই স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে বলে জানান তিনি।
মাদ্রসা বোর্ড জানায়, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সরকারের থেকে আর্থিক সুবিধা (উপবৃত্তি) পাচ্ছে। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একই স্তরে পড়াশুনা করে উপবৃত্তি পাচ্ছে না। অথচ এক অর্থে সমাজের বিরাট একটি নি¤œবিত্ত পরিবারের সন্তান মাদ্রাসায় লেখাপড়া করছে।  এমন বঞ্চনা নিরসনে সরকারকে যথাযথ প্রদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বৃত্তির বিষয়ে একটি নীতিমালা রয়েছে। যে কারণে ইবতেদায়ির শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পাচ্ছে না। তবে আমরা নীতিমালা পরিবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছি। এটি পরিবর্তন হলে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও বৃত্তি পাবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, মাদ্রাসার কতজন শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সেই সংখ্যার তথ্য আমার কাছে নেই। আমি এ বিষয়ে মাউশি মহাপরিচালক ও এনসিটিবিকে বলেছি। আশা করি পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষক প্রশিক্ষণের আওতায় আসবেন। কোথাও সমন্বয়ের ঘাটতি নেই জানালেও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যার বিষয়েও তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
নেই কোনো গবেষণা ॥ দেশের বিপুল শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করে। তবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী দাখিল (মাধ্যমিক) ও আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যায়ের আগেই ঝরে পড়ে। এসব শিক্ষার্থী পড়াশুনা কতভাগ শেষ করে, শেষ করেই বা কর্মজীবনে কি চাকরিতে প্রবেশ করে তার কোনো তথ্য মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষাবোর্ডের হাতে নেই।
মাদ্রাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার পর কোথায় কি করছে এ বিষয়ে একটি জরিপের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রায় দুই কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে এই উদ্যোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। কয়েকটি বৈঠক ছাড়া এ বিষয়ে কোনো কর্মতৎপরতা দেখা যায়নি। বোর্ডের ধারণা আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ এই জরিপের ফল প্রকাশ হতে পারে।
অথচ মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে ৮২২৯টি মাদ্রাসা ও ১৫১৯টি অনুদানভুক্ত  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা এক লাখ ৬৫ হাজারের বেশি।
নতুন শিক্ষাক্রমের কারিকুলাম শুরুই হয়নি ॥ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যেসব বিষয় এক, সেসব বিষয়ে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের কাজ চলছে। তবে বিশেষ যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলোর কারিকুলাম এখন পর্যন্ত শুরুই করেনি এনসিটিবি। এর ফলে সাধারণ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের অন্তত তিন থেকে ৫টি বিষয় অতিরিক্ত পড়তে হচ্ছে।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন কারিকুলামে প্রতি শ্রেণিতে ১০টি করে বিষয় পড়ানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে একটি মাত্র বিষয় ধর্মের পরিবর্তে অন্য একটি বিষয় প্রতিস্থাপন করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যাবস্থায় ৩-৫টি বিষয় অতিরিক্ত পড়ানো হয়। যে কারণে শিক্ষার্থীদের এখন কি পড়ানো হবে, পড়ানোর আওতা কিÑ এটি নিয়ে এনসিটিবির সঙ্গে আমরা কথা বলছি। এনসিটিবি চেয়ারম্যান মাদ্রাসা কারিকুলাম খুব দ্রুতই শুরু করার আশ^াস দিয়েছেন। 
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৯টি বিষয় বাদেও কুরআন মাজিদ ও তাজভিদ, হাদিস শরিফ, আরবি ১ম ও দ্বিতীয় পত্র, আকাইদ ও ফিকহ পড়তে হচ্ছে। এর ফলে তাদের ওপর বেশি মানসিক চাপও পড়ছে। মূলত মাদ্রাসা শিক্ষকের এ বিষয়ে আগ্রহ না থাকায় এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এর ফলে এনসিটিবিও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। 
এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মশিউজ্জামান লোকবলের ঘাটতি ও বিশেষজ্ঞের অভাবকে দায়ী করে বলেন, মাদ্রাসায় বিশেষায়িত বিষয়ে নতুন কারিকুলামের বিষয়টি শিক্ষকরা এখনো বুঝতে পারেনি। তাদের আগে বোঝাতে হবে। এর পর এ বিষয়ে কাজ শুরু করতে হবে। এই সদস্য বলেন, মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়ে অনেকবার বৈঠক হয়েছে। তারা বিশেষ বিষয়গুলো বাদ দেওয়ার বিষয়ে বরাবরই আপত্তি তুলেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন আগামী বছর থেকে এই বিষয়ে এনসিটিবি উদ্যোগ নেবে।
শিক্ষকের নেই প্রশিক্ষনের উদ্যোগ ॥ নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে মাদ্রাসার শিক্ষকরা হাত গুটিয়ে আছেন। এনসিটিবি থেকে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন না তারা। ইবতেদায়ি শিক্ষকদের এতটাই বেহাল অবস্থা যে মাত্র দুই শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। বাকি ৯৮ শতাংশ শিক্ষক শিক্ষক কবে অংশ নেবেÑ এ বিষয়ে মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকেও তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মাধ্যমিক স্তরের চিত্রও অনেকটা একই রকম।
এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ৯টি বিষয়ে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নেওয়া খুবই জরুরি। ইউটিউবে প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো আপলোড করা হয়েছে। এর পরও তাদের অংশগ্রহণ নিতে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. জিয়াউল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়ে সহকারী পরিচালক সুলতান আহমেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। পরে সুলতান আহমেদকে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

×