ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সিটি করপোরেশনের সঠিক পরিকল্পনার অভাব

রাস্তা উঁচু হয়ে অচল হবে রাজধানী

ইবরাহিম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২৩:৩২, ১৪ মার্চ ২০২৩

রাস্তা উঁচু হয়ে অচল হবে রাজধানী

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা উঁচু হওয়ায় পার্শ্ববর্তী বাড়িঘর ও দোকানপাটগুলো নিচু হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি ঢুকে পড়ে

রাজধানীর পূর্ব জুরাইন হাজী খোরশেদ আলী সরদার সড়কটি তিন বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। আগে সড়কটি সব সময় ডুবে থাকত হাঁটু পানিতে। উঁচু করে নির্মাণ করায় সড়কটিতে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা দূর হলেও এখন রাস্তার পানি ঢুকে গেছে মানুষের বাসা-বাড়ি ও দোকান-পাটে। বৃষ্টি হলেই মানুষের বাসা-বাড়ির নিচতলা ও গলিপথে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করে সহজ উপায়ে রাস্তা উঁচু করে সমাধান করা হয়েছে সমস্যার।

রাজারবাগ থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় চলাচলের উপযোগী করার জন্য দফায় দফায় রাস্তার ওপর বিটুমিনের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। কয়েক দফা সংস্কারের কারণে এই রাস্তাটি গত কয়েক বছরে অন্তত দেড় ফুট উঁচু হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে রাস্তার পানি ঢুকছে আশপাশের বাসা-বাড়ি ও দোকান-পাটে। অপরিকল্পিত সড়ক উন্নয়নই এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ। নগর পরিকল্পনাবিদের মতে রাজধানীর সড়কগুলো এখন আর এক ইঞ্চিও উঁচু করার সুযোগ নেই। পুরনো রাস্তা ভেঙে রাস্তা সংস্কারের উপায় এখনই বের করতে হবে। পুরনো রাস্তার ওপর বিটুমিনের স্তর বসিয়ে রাস্তা সংস্কার অব্যাহত রাখলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে গোটা শহর অচল হয়ে যাবে। 
সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ সড়ক গত কয়েক বছরে সংস্কার ও নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া সড়কের জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেন সংস্কার ও ফুটপাত নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক এলাকার গলিপথ কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়েছে। প্রতিবারই বিটুমিন কিংবা কংক্রিট ঢালাই হয়েছে মূল রাস্তার ওপর।

কয়েক দফা সড়ক সংস্কার শেষে দেখা যায়, স্থানীয় বাসা-বাড়ি ও দোকান-পাট থেকে সড়ক ও ফুটপাত অনেক উঁচু হয়েছে গেছে। মূল সড়কের ড্রেনের মুখ ছোট করে নির্মাণ করায় কিছুদিনের মধ্যে ময়লা পড়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। অল্প বৃষ্টিতেই গলিপথের ড্রেনের ময়লা সব বাসা-বাড়ির সামনে জমা হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান। 
পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা জসিম উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পূর্ব জুরাইনের হাজী খোরশেদ আলী সরদার সড়কটি দীর্ঘদিন পানির নিচে ডুবে ছিল। পানি নিষ্কাশনের অভাবে রাস্তাটি ডুবে থাকত পুরো বর্ষাকাল। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করে তিন বছর আগে এই সড়কটি সংস্কার করা হয়েছে প্রায় এক ফুট উঁচু করে। সড়ক বেশি উঁচু করার কারণে আমাদের বাসা-বাড়ি নিচু হয়ে গেছে। এছাড়া গলিপথগুলো সংস্কার না করায় অল্প বৃষ্টিতে বাসা-বাড়ির সামনে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। গলিপথের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টি হলেই বাসা-বাড়ির সামনে জমা হতে থাকে। নোংরা পানিতে চলাচল করতে ভোগান্তি পোহাতে হয় এলাকার বাসিন্দাদের।’
হাজী খোরশেদ আলী সরদার সড়কের পাশে একটি সেলুনের দোকান চালান দয়াময় সেন। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করেন তিনি। সড়ক থেকে তার সেলুনের দোকানটি প্রায় ৪ ফুট নিচু। দুই ধাপ সিঁড়ি দিয়ে গ্রাহকদের দোকানে প্রবেশ করতে হয়। দয়াময় সেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সড়ক বেশি উঁচু হওয়ার কারণে দোকান নিচু হয়ে গেছে। বেশি বৃষ্টি হলেই দোকানে পানি ঢুকে। তখন বালতি দিয়ে পানি পরিষ্কার করতে হয়। বেশি বৃষ্টি হলে সেলুনটি বন্ধ রাখতে হয়।’
গত ৬/৭ বছরে রাজধানীর সিদ্ধেশ^রী রোডটি নানা কারণে কাটাকাটির পর তিন দফায় সংস্কার করা হয়েছে। বার বারই কমপক্ষে ছয় ইঞ্চি করে কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়। এতে রাস্তাটির উচ্চতা বেড়েছ অন্তত দেড় ফুট। ধলপুরের সুতিখালপাড় এলাকার সড়কটি গতবছর সংস্কার করা হয়েছে। এই সড়কে কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া হয়। এখন সড়কের উচ্চতা বেড়ে গেছে অনেকটা। স্থানীয় বাসা-বাড়ি থেকে সড়কটি ২-৩ ফুট উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি হলেই বাসা-বাড়ির সামনের গলিপথে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।

সুতিখালপাড়ের মসজিদ গলির বাসিন্দা আব্দুর রহিম মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সড়ক সংস্কার করার কারণে একদিকে ভালো হয়েছে। অন্যদিকে আরও বিপদ বাড়ছে। রাস্তা উঁচু হওয়ার কারণে বাসা নিচু হয়ে গেছে। তাই অল্প বৃষ্টিতেই বাসার সামনে পানি জমে। পানি যাতে বাসায় ঢুকতে না পারে এজন্য গেটের সামনে উঁচু করে বেরিক্যাড দেওয়া হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করে পুরনো রাস্তা ভেঙে আগের উচ্চতায় রাস্তাটি করা হলে এই সমস্যা হতো না।’ 
একই অবস্থা রাজধানীর প্রায় সকল এলাকায়। ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)’র আওতায় রাজধানীর মগবাজার মোড় থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও ফুটপাত নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়ে চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের দুই পাশে দুই কিলোমিটার ড্রেন ও দুই কিলোমিটার ফুটপাত নির্মাণ করা হচ্ছে। সড়কটি সংস্কার করে প্রায় চার ইঞ্চি কার্পেটিং করা হয়েছে।

সড়কটির পুরাতন কার্পেটিং রেখেই আবার পিচ ঢালাই করার কারণে ৩-৪ ইঞ্চি উঁচু হয়ে গেছে। গত কয়েক বছরে অন্তত ৫/৬ বার পিচ ঢালাই দিয়ে সড়কটি প্রায় দেড় ফুট উঁচু করা হয়েছে। সড়কের পাশে উঁচু করে ফুটপাত নির্মাণের কারণে স্থানীয় বাসা-বাড়ি ও দোকান-পাটও নিচু হয়ে গেছে। বৃষ্টির সময় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা।
আশরাফুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক দোকানদার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ফুটপাত থেকে তার দোকানটি প্রায় দেড় ফুট নিচু হয়ে গেছে। এর আগেও দোকানের মেঝে উঁচু করা হয়েছে। এখন আর মেঝে উঁচু করার সুযোগ নেই। বৃষ্টি হলেই দোকানে পানি জমে যাবে। সড়ক নির্মাণের সময় রাস্তা ভেঙ্গে আগের উচ্চতায় রাস্তটি সংস্কার করার কথা বলা হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের লোকেরা বলেন, এটি আমাদের সিদ্ধান্ত নয়, সিটি করপোরেশন যেভাবে টেন্ডার করেছে সেভাবেই আমরা কাজ করছি।’

ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মগবাজার থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার করা হচ্ছে। নতুন করে নির্মাণ করা হয়নি। তাই পুরাতন কার্পেটিংয়ের ওপর আবার কার্পেটিং করা হয়েছে। সড়ক উচ্চতার মান বজায় রেখেই কার্পেটিং করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে একটু উঁচু মনে হলেও পুরো কাজ শেষ হলে তেমনটা মনে হবে না।’ 
সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে নতুন সড়ক নির্মাণের সঠিক মান বজায় রাখা হয় না। দেখা যায় পুরাতন সড়ক সংস্কারের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়। সড়ক সংস্কারের সময় পুরাতন কার্পেটিং না তুলে ওপর দিয়ে আবার কার্পেটিং করা হয়। এতে বিদ্যমান সড়কটি দিনের পর দিন উঁচু হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা থেকে নিচু হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি। বর্ষার সময় সড়কের পানি সব বাসা-বাড়ি ও দোকান-পাটে জমা হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা হচ্ছে সিটি করপোরেশনের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে।

রাস্তা সংস্কারের প্রয়োজন হলেই বিটুমিনের স্তর বসিয়ে সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বিদ্যমান সড়কের উচ্চতা বিবেচনা করেই বাসা-বাড়ি ও দোকান-পাট তৈরি করেন। দেখা যায়, সড়কটি সংস্কার করতে করতে কয়েক বছরের মধ্যে তা বসত বাড়ি থেকে ২-৩ ফুট উঁচু হয়ে যায়। এভাবে উঁচু হতে থাকলে স্থানীয় বাসিন্দারা স্থায়ী জলাবদ্ধতায় বন্দি হয়ে পড়বেন।’
রাস্তা উঁচু হয়ে যাওয়া সংস্কারের প্রচলিত পদ্ধতি বদলাতে ২০১৬ সালে প্রায় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কোল্ড মিলিং মেশিন’ ও ‘কোল্ড রিসাইক্লিং প্লান্ট’ নামে দুটি আধুনিক যন্ত্র কিনেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। মিলিং যন্ত্রটি দিয়ে রাস্তায় ১৩ ইঞ্চি গভীর পর্যন্ত পিচ ও ইটপাথর কাটা যায়। ১২ ফুট প্রস্থের এক কিলোমিটার রাস্তা কাটতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। কাটার পর বেরিয়ে আসা ইটপাথর ও পিচ পুনঃপ্রক্রিয়া করা হয় রিসাইক্লিং যন্ত্র দিয়ে।

এভাবে যন্ত্র দুটি দিয়ে এক কিলোমিটার সড়ক সংস্কার করতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। ২০১৬ সালে যন্ত্র দুটি দিয়ে পলাশী থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন বলেছিলেন, ‘পর্যায়ক্রমে আরও যন্ত্র কিনে শহরের সকল রাস্তাই এভাবে সংস্কার করা হবে। ঠিকাদাররা সিটি করপোরেশন থেকে ভাড়া নিয়ে রাস্তা সংস্কারের কাজ করবেন।’
এই পদ্ধতিতে আরও কয়েকটি সড়ক সংস্কার করা হয়েছিল। পরে যন্ত্র দুটির আর ব্যবহার হয়নি। বিশে^র সকল শহরে এই পদ্ধতিতে সড়ক সংস্কার করা হয়। আমাদের দেশে রহস্যজনক কারণে এই আধুনিক পদ্ধতি চালু করেও তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুরনো পিচ না তুলে এর ওপর নতুন পিচ বসানোর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটি করপোরেশনের এক ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের দেশে এখনও রাস্তা সংস্কারে কোল্ড মিলিং ও কোল্ড রিসাইক্লিং মেশিনের প্রচলন শুরু হয়নি।

এই মেশিনে পুরনো পিচ, ইট ও পাথর তুলে রিসাইক্লিং করে আবার রাস্তা সংস্কারের কাজে ব্যবহার করা যায়। মেশিন পাওয়া গেলে রাস্তা সংস্কারের খরচ ও সময় অনেক কমে যেত। ঠিকাদারদের পক্ষে এইসব ব্যয়বহুল মেশিন কিনে রাস্তার কাজ করা কঠিন। সিটি করপোরেশন যে দুটি মেশিন কিনেছিল তা অদৃশ্য কারণে আর ব্যবহৃত হয়নি। দীর্ঘদিন ফেলে রাখা ও মেনটেন্যান্সের অভাবে এগুলো অকেজো হয়ে গেছে। আমাদের এখনো পুরনো পদ্ধতিতেই রাস্তা সংস্কার করতে হয়।

লেবার বা ভেকু মেশিন দিয়ে পুরনো পিচ তুলতে গেলে অতিরিক্ত সময় ও খরচের প্রয়োজন হয়। সিটি করপোরেশন সেদিকে যেতে চায় না। বাজেট পাওয়া না গেলে আমাদের পক্ষেও পুরনো পিচ অপসারণ করে নতুনভাবে রাস্তা করা সম্ভব হয় না। তাই পুরনো পিচের ওপরই নতুন করে সংস্কার করা হচ্ছে। এতে রাস্তা যেমন উঁচু হচ্ছে তেমনি দ্রুত রাস্তাটি নষ্টও হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার দুই সিটিতে সব মিলিয়ে রাস্তার পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির ২৭টি প্রধান সড়ক এবং ২৫০টির মতো অভ্যন্তরীণ সড়ক (গলিপথ) রয়েছে।

×