ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

১৬ হাজার একর জমি অবৈধ দখলে

রেলের আয় বাড়াতে সংশোধন হচ্ছে নীতিমালা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ১২ জানুয়ারি ২০২৩

রেলের আয় বাড়াতে সংশোধন হচ্ছে নীতিমালা

সারাদেশে রেলওয়ের প্রায় ৬১ হাজার ৮৬০ একর জমি রয়েছে

সারাদেশে রেলওয়ের প্রায় ৬১ হাজার ৮৬০ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৫৬৯ একর জমি রেল ব্যবহার করছে। বাকি ৩০ হাজার ২৯১ একর জমি বিভিন্ন স্থানে ইজারা দেওয়া ও অবৈধ দখলে রয়েছে। ইজারা বাদে প্রায় ১৬ হাজার একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। ইজারা দেওয়া ১৪ হাজার একর জমি থেকে যে পরিমাণে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা তা পাচ্ছে না রেলওয়ে। অথচ প্রতিবছর যাত্রী পরিবহন ও অন্যান্য খাতে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে।
তাই রেলওয়ের আয় বাড়ানো ও ভূমির সঠিক ব্যবহারের জন্য ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২০ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ে খসড়া নীতিমালা বিষয়ে এক পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এ সময় রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর ও রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে রেল সচিব ড. হুমায়ুন কবীর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ছিল। একটি নীতিমালা থাকলেও তা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি। তাই নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রেলওয়ের যে পরিমাণ জমি আছে, তা থেকে কিভাবে আয় বাড়ানো যায় তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

রেলওয়ে একটি যাত্রীবান্ধব পরিবহন। যাত্রী পরিবহনে সব সময় লোকসান দিতে হচ্ছে। তাই যাত্রী পরিবহন ঠিক রেখে অন্যান্য খাত থেকে কিভাবে আয় করা যায় তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। খসড়া নীতিমালায় অনেক প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো ঠিক করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। বৃহস্পতিবার  বৈঠকে আংশিক আলোচনা হয়েছে।’ চলতি মাসের শেষদিকে আরেকটি বৈঠকে তা ঠিক করা হবে বলে জানান তিনি।  
রেলওয়ে সূত্র জানায়, দুই বছর আগে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২০ সংশোধন করা হয়েছিল। নতুন করে এখন আবার সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নীতিমালার ২৩ ধারা অনুযায়ী, বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় রেলের ইজিপি দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়। খসড়া সংশোধনীতে, উš§ুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জমি ইজারার প্রস্তাব করা হয়েছে। লাইসেন্স গ্রহীতা ইজারা নেওয়া জমির লাগোয়া প্লট ১০গুণ ফি বেশি দিয়ে লিজ নিতে পারবেন।
রেলের জমি ইজারা প্রদানে স্বচ্ছতা আনয়নে ভূমি মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয়েছিল দুবছর আগের সংশোধিত নীতিমালায়। সর্বশেষ খসড়া নীতিমালায় ভূমি মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত না রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে রেল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততার কারণে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়কে সরিয়ে দিলে এ বিষয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতা পাবে রেল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে যারা রেলের জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন, তারা রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে ও নির্দিষ্ট ফি দিয়ে সেসব জমির বৈধতা পাবেন প্রস্তাবিত সংশোধনীতে অবৈধ দখলদারদের বৈধতা প্রদানের এ সুযোগ রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সংশোধনীতে সুযোগ রাখা হয়েছে অ্যাপার্টমেন্ট-শপিংমলসহ বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের।
রেলওয়ের বিদ্যমান নীতিমালায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থার কর্মকান্ডের প্রয়োজনে অর্থাৎ পরিষেবামূলক কাজে ভূমি ব্যবহারের সুযোগ রাখা আছে। এতে করে যে কোনো মোবাইল কোম্পানির অপটিক্যাল ফাইবার লাইন, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন পাইপলাইন, গ্যাসলাইন, টেলিফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, বাঁধ, রাস্তা, নর্দমা ইত্যাদি স্থাপন ও নির্মাণের কথা বলা আছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমি বরাদ্দ কমিটির সুপারিশের কথা উল্লেখ করেছে রেলওয়ে।
সূত্রমতে, নীতিমালায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে ৪৬ ধারায়। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে জমি দিতে এ ধারায় ‘গ’ এবং ‘ঘ’ উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। নীতিমালার ২৪ ধারা সংশোধন করে অবৈধ দখলদারকে বৈধ হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে খসড়ায়। রেলের জমিতে যারা বর্তমানে আইনগত ভিত্তি ছাড়াই অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছেন, তারা ২০গুণ বেশি ফি দিয়ে সেসব স্থাপনার বাণিজ্যিক লাইসেন্স নিতে পারবেন। নির্ধারিত বাৎসরিক ফি দিয়ে জমি ব্যবহারও করতে পারবেন। ৩০ ধারার সংশোধনীতে প্রস্তাব করা হয়েছে, অবৈধভাবে দখল করা কৃষি জমি তিনগুণ ফি দিয়ে ইজারা নিয়ে বৈধ করা যাবে।
২০২০ সালের নীতিমালার ৪৩ ধারায় ২০(খ) এবং ২০ (গ) শ্রেণিভুক্ত জমি পিপিপির মাধ্যমে বরাদ্দের সুযোগ রাখা হয়েছিল। তবে এ নিয়ম শিথিল করে জয়েন্ট ভেঞ্চার (যৌথ উদ্যোগ) প্রস্তাব রাখা হয়েছে খসড়ায়। নীতিমালার ৬০টি ধারার ১৩টি সংশোধন করতে খসড়া করেছে রেল। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন প্রধান ব্যবসা হলেও, ‘নন-কোর বিজনেস’ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদে জমি ভাড়া দিয়ে আয় বাড়াতে চায় বলে খসড়ায় যুক্তি তুলে ধরেছে রেলওয়ে। 
লোকসানে ধুঁকতে থাকা রেল বর্তমানে কৃষি কাজের জন্য এক বছরের জন্য জমি ভাড়া দেয়। বাণিজ্যিক কাজে স্বল্প মেয়াদে অর্থাৎ এক থেকে তিন বছরের জন্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে অর্থাৎ তিন থেকে বিশ বছর মেয়াদে জমি ইজারা দেওয়া হয়। নীতিমালার ৪(ট) ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তা অনুমোদিত হলে ৫০ বছরের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হবে। কৃষি জমি ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র হিসাবে ইজারা দেওয়া হয়। খসড়া সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বাংলা সনের পরিবর্তে ১ জুলাই থেকে ৩০ জুন হিসাবে ইজারা দেওয়া হবে। 
জানা গেছে, লাইসেন্সকৃত জমি বা জমির অংশ বিশেষ বাংলাদেশ রেলওয়ে বা সরকারের প্রয়োজন হলে তা ৩০ দিনের নোটিসের মাধ্যমে ওই ভূমির লাইসেন্স বাতিল ও ভূমির দখল গ্রহণ করা যাবে। প্রস্তাবিত খসড়ায় অবশ্য ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রেলের নীতিমালার ৫২ ধারা অনুযায়ী খোলা জমির বার্ষিক বাণিজ্যিক ফি এলাকাভেদে প্রতি বর্গফুটে ১৫ থেকে ১০০ টাকা; আচ্ছাদিত জমি প্রতি বর্গফুটে ১৮ থেকে ১৫০ টাকা। রেলের অনেক জমি গত ৫০ বছরে বেহাত হয়ে গেছে। 
নীতিমালার ২০ ধারায় রেলের জমির শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। যেসব জমি অদূর ভবিষ্যতে কাজে লাগবে সেগুলো ২০(খ) উপধারাভুক্ত। যেগুলো সুদূর ভবিষ্যতে কাজে লাগবে সেগুলো ২০(গ) উপধারাভুক্ত। খসড়া সংশোধনীতে বলা হয়েছে, আগামী ১০০ বছরের উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত জমি রেখে ২০ (গ) ভুক্ত জমি দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ ৫০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া যাবে। 

×