ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আমন বীজতলা করতে বাধা

কলাপাড়ায় ক্যাডারদের পৌষ মাস ॥ কৃষকের সর্বনাশ

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৯ জুলাই ২০১৭

কলাপাড়ায় ক্যাডারদের পৌষ মাস ॥ কৃষকের সর্বনাশ

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, ৮ জুলাই ॥ বুধবার রাত থেকে কলাপাড়ার উপকূলে বিরামহীন ভারি বৃষ্টিপাত থেমেছে। কিন্তু হাজার হাজার কৃষকসহ সাধারণ পরিবারের পানিবন্দীদশা কাটেনি। তিন দিনের ভারি বৃষ্টিতে জমা পানি নামতে পারছে না। পানি অপসারণের কালভার্ট, খাল ও খালের সামনের স্লুইসসংলগ্ন এলাকায় বাঁধ দিয়ে মাছ ধরার কারণে মানুষের পানি বন্দীদশা কাটছে না। খাল, কালভার্ট, স্লুইস কোন কিছুই কৃষকের নিয়ন্ত্রণে নেই। এসব এখন সরকার এবং অন্য রাজনৈতিক দলের ক্যাডার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা মাছ ধরছে। ফলে কৃষকের কৃষি কাজে চরম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এসব ক্যাডাররা এতটাই প্রভাবশালী যে কৃষক ভয়ে এদের নামটি পর্যন্ত মুখে আনতে সাহস পায় না। জিজ্ঞেস করলে কথা পর্যন্ত বলতে চায় না। উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সব কটি ইউনিয়নে সরকারী দলের সমর্থিত চেয়ারম্যান রয়েছেন। তারা কৃষকের এ স্বার্থ রক্ষায় চরম উদাসীন। বরং তাদের ছত্রছায়ায় অধিকাংশ কালভার্ট, খাল, স্লুইস নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররাÑ এমন এন্তার অভিযোগ। উপজেলা প্রশাসনও এ বিষয়ে চরম নীরবতা পালন করছে। ফলে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের চরম বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কালভার্ট, খাল এবং স্লুইসগেট নিয়ন্ত্রণ করে আবার বিনিময় রয়েছে। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে মাছও যায় নিয়ন্ত্রক গডফাদারদের বাসায় বাসায়। মোট কথা জিম্মিদশায় পড়েছে সাধারণ মানুষসহ কৃষকরা। কৃষক এখন জলাবদ্ধতার কারণে বীজতলা করতে পারছে না। অন্তত দুই শ’ কালভার্ট ও স্লুইস এভাবে অনিয়ন্ত্রিত রাখা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, টিয়াখালীর বিশকানি পয়েন্টে বিশাল এলাকা পানিবন্দী হয়ে আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কৃষক জানালেন, আগে পানি নামত নাচনাপাড়া চৌরাস্তার স্লুইসগেট দিয়ে। বহু আগে পানি চলাচলের খালের জমি কার্ড (বন্দোবস্ত) নেয় এক সাবেক মেম্বার। তিনি আবার বিক্রি করে দেয় সাবেক এক এমপির ছেলের কাছে। তার কাছ থেকে অনেকজনে কিনে একাধিক বাড়িঘর করেছে। এখন পানি প্রবাহের ওই পথ রুদ্ধ। পানি চলাচলের বিকল্প পথে রয়েছে দুই মুখের কালভার্ট। এক মুখ মাটি ভরাট করা হয়েছে। অপর মুখে তক্তা দিয়ে পাটাতন করে নিচে জাল পাতা হয়। পানি চলাচল জাল পাতার ওপর নির্ভরশীল। ওই কালভার্টটিতে জাল পাতেন ভাড়াটে হোন্ডাচালক মনির। এলাকার লোকজনের ভাষ্য প্রত্যেকটি কালভার্ট এভাবে মাছ ধরার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে। কৃষকের কোন অংশগ্রহণ তো দূরের কথা, পানি আটকে থাকার বিষয় প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই। বাদুরতলীর বিরাট খালটির সিকদার বাড়ি এলাকায় ব্রিজের নিচে পানি চলাচলের পথ মাটি ভরাট করে বন্ধ করা হয়েছে। এখালটির দুই দিকে এখন বাড়িঘর তোলা হচ্ছে। মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের মেলাপাড়া থেকে আজিমদ্দিন গ্রামমুখী সড়কের আবগঞ্জের এবং ময়ুর খালের পানি চলাচল করে যে কালভার্ট দিয়ে তা মাটি ভরাট করে রেখেছেন স্থানীয় সালাম হাওলাদার। কালভার্টের সামনে বাঁধ দিয়ে করেছেন মাছের ঘের। দুই দিকে পানি এখন আর চলাচল করতে পারছে না স্বাভাবিকভাবে। গ্রামবাসী লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু তিন মাসেও কোন প্রতিকার পায়নি। এমনকি ওই খালের মধ্যে তোলা টং ঘরে মাদক বিক্রি ও সেবন করা হয়। চলে জুয়ার আসর। এসবও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। বালিয়াতলী ইউনিয়নের বৌদ্ধপাড়া চৌরাস্তা থেকে পক্ষিয়াপাড়া যেতে সড়কটির দুইদিকে পানিতে সব থই থই করছে। কালভার্ট ও স্লুইসের সামনে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল পাতা। এভাবে ১২টি ইউনিয়নসহ দুটি পৌরসভারও একই হাল-হকিকত। কৃষকসহ সাধারণ মানুষ পড়েছে চরম দুর্ভোগে। লালুয়ার চৌধুরীপাড়া, মুন্সীপাড়া, নাওয়াপাড়াসহ ছয়টি গ্রামের পানি নামার একমাত্র পথ মুন্সীপাড়ার স্লুইসগেট। তার সামনে একাধিক পয়েন্টে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল পাতায় পানি ঠিকমতো নামতে পারছে না। এমন দৃশ্য সর্বত্র। কোথাও কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। স্লুইস, খাল, কালভার্ট। সব নিত্য আয়ের টাকার খনিতে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক ক্যাডারদের। যার দায়ভার চাপছে সরকারী দলের ওপর। একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান এসবের সত্যতা স্বীকার করে কেউ কেউ এদের নিবৃত করতে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। কৃষকের অভিযোগ, গড়ে এক কালভার্ট থেকে দৈনিক কমপক্ষে পাঁচ শ’ টাকা এবং স্লুইসগেট থেকে এক হাজার থেকে দশ হাজার টাকার মাছ ধরা হয়। আর এ লোভেই কৃষকের কৃষিকাজে সর্বনাশ হচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মসিউর রহমান জানান, এখন আমনের বীজতলা করার সময়। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে অনেক কৃষক তা করতে পারছে না। পানিবন্দী দশার এসব সমস্যা উপজেলা পরিষদের সভায় তিনি অবহিত করে আসছেন বলে জানালেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) বিপুল চন্দ্র দাস জানান, কৃষকের এ সমস্যাটি লাঘবে তিনি সব কটি তহশিলে বলে দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম সাদিকুর রহমান জানান, পানি সরবরাহের পথ আটকে কেউ কৃষিকাজে ব্যাঘাত যেন ঘটাতে না পারে এ জন্য তিনি চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এত সবের পরেও কালভার্ট কিংবা স্লুইসগেট আটকে মাছ ধরা বাস্তবে বন্ধ হয়নি। হয়নি লাঘব পানিবন্দী দশার।
×