বছরের শেষ মাস। ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস। এ মাস পরীক্ষার মাসও। সুমনার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। দাদাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে সুমনা। মাকে সঙ্গে নিয়ে।
সুমনা দাদাভাইকে বলল, ‘দাদাভাই, আমি এসে গেছি।’
দাদাভাই খুশি হয়ে বললেন, ‘তোমার অপেক্ষায় ছিলাম। কখন আসবে আমার নাতনি।’
সুমনা মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘পরীক্ষা তো গতকাল শেষ হলো। আজ চলে এলাম।’
সুমনার ডান হাত ধরে দাদাভাই পাশে বসালেন। বললেন, ‘এসেছ, ভাল করেছ। তোমাকে গল্প শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। অবশেষে তুমি এলে।’
সুমনা খুশি হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাভাই। তোমার কাছ থেকে গল্প শুনব। গল্প শোনার লোভেই তো তোমার কাছে আসি। তোমার মুখ থেকে গল্প শুনতে খুবই মজা পাই। তুমি যেন গোপাল ভাঁড়।’
গোপাল ভাঁড়ের কথা শুনে দাদাভাই মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘তাই! আগে বলোনি তো। আজ তোমাকে অন্য রকমের গল্প শোনাব।’
অন্যরকম গল্প শোনার কথা শুনে সুমনা ভাবনায় পড়ে গেল। অন্যরকম গল্প কী হতে পারে। পরী, ভূত, ডাকাত ও রাক্ষসের গল্প তো শুনেছি। আজ আবার অন্যরকমের গল্প কিসের। সুমনা সাহস করে দাদাভাইকে বলল, ‘অন্যরকম গল্প, এ গল্প আবার কী ধরনের গল্প দাদাভাই?’
দাদাভাই বললেন, ‘এখন ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস। তাই তোমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাব। তোমাকে এর আগে অনেক গল্প শুনিয়েছি। এখন তোমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনানো দরকার। কারণ তুমি এখন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা শিখবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় হবে।’
‘অবশ্যই দাদাভাই। তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তোমার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব। তবে দাদাভাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার মানে বুঝলাম না। আমাকে একটু বলবে?’
দাদাভাই খুশি হয়ে সুমনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি ভাল কথা বলেছ সুমনা। চেতনা সম্পর্কে বলছি- অনুভূতি বা জ্ঞানের নাম চেতনা। ‘বাংলাদেশ’ হলো আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে দেশটির নাম দেয়া হয় ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। পাকিস্তানী শাসকদের ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য ঘৃণা করার নামই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা...।
‘দাদাভাই, তুমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে ধারণা পেলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেই বড় হব আমি। তোমাকে আজ কথা দিলাম।’
দাদাভাই বললেন, ‘আমি খুশি হলাম। তুমি চেতনায় সচেতন হয়ে গড়ে উঠবে একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। দেশ সম্পর্কে আরও অনেক কিছু বলব। তুমি ধৈর্য ধরে শুনবে। নিজের চেতনায় ধারণ করবে।’
‘ঠিক আছে দাদাভাই। আমি তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’
সুমনার মা রুমে এলেন। এসে বললেন, ‘দুজন বেশ জমিয়ে গল্প করা হচ্ছে। আমি কি জানতে পারি। আজকের গল্পের বিষয়?’
সুমনা বলল, ‘আজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গল্প।’
মা বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা তোমার দরকার। এ প্রজন্মের সবারই প্রয়োজন।’
সুমনা বলল, ‘তাই! মা। তাহলে তুমিও কিন্তু আমাকে আরও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবে।’
মা বললেন, ‘অবশ্যই শোনাব।’
‘ঠিক আছে মা।’
মা রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।
সুমনা বলল, ‘দাদাভাই, এবার গল্প শুরু কর।’
দাদাভাই মনে মনে কি যেন ভাবছেন। তারপর বললেন, ‘সুমনা, তোমাকে এখন আর গল্প বলব না। তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। সেখানে গিয়ে তোমাকে গল্প শোনাব।’
‘সেখানে গিয়ে গল্প শুনতে হবে। সেখানে যাওয়ার কি খুবই দরকার দাদাভাই।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই যাওয়া দরকার।’
‘তা হলে চলো দাদাভাই।’
ওরা দুইজন বাসা থেকে বের হলেন। বাসা থেকে বের হয়ে দাদাভাই বললেন, ‘যেদিন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। আজ হঠাৎ সে দিনের কথা মনে পড়ল সুমনা। কত মায়ের সন্তান বাড়ি থেকে বের হয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এমন কয়েকজন শহীদের স্মৃতিস্তম্ভর সামনে তোমাকে নিয়ে যাব এখন।’
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শুনে সুমনার শরীর কেপে উঠল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’
দাদাভাই আর সুমনা স্মৃতিস্তম্ভর দিকে যেতে লাগল।
কিছু দূর যাওয়ার পর সুমনা বলল, ‘আচ্ছা দাদাভাই, সেদিন পত্রিকায় খবর দেখলাম। এক মুক্তিযোদ্ধা নারী ভিক্ষা করছেন। খবরটা পড়ে আমার খুব খারাপ লেগেছে।’
দাদাভাই বললেন, ‘এ রকম মুক্তিযোদ্ধা অনেক আছে। যারা আজ অবহেলিত বঞ্চিত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কতটুকু এখন বিদ্যমান। কিছু কিছু বিষয়ে দেখলে সত্যি বড় কষ্ট হয়।’
দাদা ভাইয়ের আবেগ তাড়িত হয়ে গেলেন। সুমনা বুঝতে পারলেন। বুঝতে পেরে অন্যমনস্ক করার জন্য সুমনা বলল, ‘দাদাভাই আমরা যেন কোথায় যাচ্ছি।’
দাদাভাই তখন মাথা উঁচু করে সুমনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও আমরা তো শহীদের স্মৃতিস্তম্ভর দিকে স্কুল মাঠে যাচ্ছি।’
ওরা এগিয়ে যাচ্ছে। স্কুল মাঠে গিয়ে উপস্থিত হলো। শহীদের স্মৃতিস্তম্ভর সামনে দাঁড়াল ওরা।
সুমনা বলল, ‘দাদাভাই, এটা কাদের স্মরণে করা হয়েছে?’
দাদাভাই বললেন, ‘আমাদের গ্রামে যারা মুুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। তাদের নামে এই স্মৃতিস্তম্ভর করা হয়েছে। পড়ে দেখ তাদের নাম আছে।’
সুমনা এগিয়ে নামগুলো পড়তে লাগল। নামগুলো পড়া শেষে বলল, ‘দাদাভাই, বাংলাদেশের সব অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নাম এভাবে যত্ন করে লিখে রাখা হয়েছে?’
সুমনার বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন শুনে দাদাভাই বললেন, ‘আমি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় গিয়েছি। কোথায় এমন স্মৃতিস্তম্ভ দেখি নাই। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জানানোর জন্য প্রত্যেক এলাকায় এমন স্মৃতিস্তম্ভ করা দরকার ছিল। এই স্মৃতিস্তম্ভ আমি আমার নিজ উদ্যোগে করেছি।’
‘তুমি ঠিক কি বলেছ দাদাভাই। প্রতিটি গ্রামে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি করে স্মৃতিস্তম্ভ করত তাহলে এ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা খুবই সহজ হতো। এই উদ্যোগটা সরকার নিতে পারে না দাদাভাই।’
দাদাভাই বললেন, ‘সরকার ইচ্ছা করলেই এমন উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে পড়ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।’
‘তুমি ঠিক বলেছ।’
সুমনা সকল মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করল। স্কুলে মাঠে অনেক শিশু-কিশোর এসে হাজির হলো। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে শুরু করলেন দাদাভাই।
শীর্ষ সংবাদ: