ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

দখলীয় ১৪ বিঘা জমি উদ্ধার

জবির তিব্বত হল আজও হাজী সেলিমের দখলে

প্রকাশিত: ০১:২৫, ২ নভেম্বর ২০২০

জবির তিব্বত হল আজও হাজী সেলিমের দখলে

মামুন শেখ, জবি ॥ রাজধানীর পুরান ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট এলাকার ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেনে ৮ দশমিক ৮৮৯ কাঠা জায়গায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ‘তিব্বত হল’। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অর্পিত সম্পত্তি শাখার (স্মারক জেপ্রঢা/অর্পিত/১১৮৩) তথ্য অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলকৃত ১২টি হলের মধ্যে ‘তিব্বত হল’ একটি। হলটি বর্তমানে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দখলে। ২০০১ সালে হাজী সেলিম হলটির অবকাঠামো পরিবর্তন করে তার স্ত্রীর নামে ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’ নামক বহুতল বিপণিবিতান তৈরি করেন। হলটি উদ্ধারে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় আন্দোলনে সরকারের উচ্চমহলের আশ্বাসের পরেও আজও বেদখলে। ২০০৯ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ হল উদ্ধারের দাবি জানায়। প্রায় ১৪ হাজার বর্গফুটের যে খালি জায়গাটি (তিব্বত হল) অবৈধ দখলদার কর্তৃক ব্যবহৃত হচ্ছে, প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের উচ্ছেদ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা প্রতিষ্ঠা পূর্বক হল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস নির্মাণের ডামাডোলে জগন্নাথের হলগুলো আজও বেদখলে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের হলগুলো উদ্ধার কার্যক্রমের কোন উদ্যোগ নেই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, এগুলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কখনও মালিকানা ছিল না। এগুলো হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ি, ছাত্ররা এখানে থাকত। পুরনো হলগুলো নিয়ে যে মামলা মোকদ্দমা চলছে তা জগন্নাথের সঙ্গে না। হলগুলোর মালিক হাজী সেলিমও না। হলগুলো তিনি তিন বেচা দিয়েছে। সরকারের উচিত এগুলো উদ্ধার করে প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেয়া। জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) বেদখলকৃত হলসমূহে ১৯৮৫ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বসবাস করে আসছিলেন। ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলায় স্থানীয়দের সঙ্গে শহীদ আব্দুর রহমান হলের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর তিনটি বাদে বাকি হলগুলো বন্ধ করে দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে পাটুয়াটুলীর ওয়াইজঘাট ৮ ও ৯ নম্বর জিএল পার্থ লেনের ‘তিব্বত হল’ একটি। শিক্ষার্থীরা নব্বইয়ের দশকে একবার হলটি ফেরত নিতে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে স্থানীয়রা ওই ভবনের দোতলায় আগুন দিলে তখনকার অধ্যক্ষ ড. হাবিবুর রহমান শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনেন। পার্থ লেনের বিভিন্ন স্থানে ২০১১ সাল পর্যন্ত ‘তিব্বত হল’ লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেলেও শিক্ষার্থীরা আর সেখানে ফিরতে পারেননি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা হলটি ‘ঘেরাওয়ে’ গেলে হাজী সেলিমের সমর্থকরা হামলা করে এবং পুলিশ লাঠিপেটা ও গুলি করে। ওইদিন বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজী বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দীন গুলিবিদ্ধসহ তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধার আন্দোলনে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হল উদ্ধারে আন্দোলন করে। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকেও এ হল উদ্ধারে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে তা স্থমিত হয়ে যায়। সরকারের উচিত এ জায়গা উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা। হল উদ্ধার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এফ এম শরীফুল ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালে যখন আমাদের হল উদ্ধার আন্দোলন তীব্র তখন সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদকে আহ্বায়ক করে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হল উদ্ধার কমিটি গঠন করে। এ কমিটির আমিও একজন সদস্য। ২০০৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে হাজী সেলিম গুলশান আরা সিটির অবকাঠামো পরিবর্তন করে দোকান হিসেবে পজিশন বিক্রি করে দেয়। তখন হল উদ্ধার আন্দোলনে হাজার হাজার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি হতে হয়। তাই আমরা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারিনি। হল উদ্ধারে সরকার কর্তৃক গঠিত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হল উদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক জগন্নাথ কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক ভিপি ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল উদ্ধারের জন্য একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। কয়েকটি হল উদ্ধারও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এ বিষয়ে কোন খোঁজখবর না রাখায় হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। গুলশান আরা সিটি মার্কেটের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হাজী মোঃ মজিবুর রহমান বলেন, মার্কেটটি কখনও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল না। এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছিল না এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সে সময়ে একটি চিঠিও দিয়েছে। দখলকৃত ১৪ বিঘা জমি উদ্ধার ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, সোনারগাঁয়ে হাজী সেলিমের মালিকানাধীন মদিনা গ্রুপের নামে দখলকৃত ১৪ বিঘা সরকারী জমি দখলমুক্ত করেছে উপজেলা প্রশাসন। রবিবার বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল মামুনের নেতৃত্বে মেঘনাঘাট এলাকায় এ অভিযান চালিয়েছেন। সোনারগাঁ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আল মামুন জানান, সরকারী জমি দখল করে মদিনা গ্রুপ অবৈধভাবে যতগুলো স্থাপনা নির্মাণ করেছে সেগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি। দখলকৃত জমিতে নির্মাণাধীন তিনটি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছি। দখলকৃত জমিতে বাকি যে স্থাপনাগুলো রয়েছে সেগুলো অপসারণের জন্য মদিনা গ্রুপের কর্তৃপক্ষকে তিনদিনের মধ্যে অপসারণ করতে নির্দেশ দিয়েছি। কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে অবৈধ স্থাপনা অপসারণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অভিযানের সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, মদিনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজী সেলিমের মালিকানাধীন মদিনা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করার জন্য মেঘনাঘাট এলাকায় চর রমজান সোনাউল্লাহ মৌজায় দিয়ারা ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ৭৪১০, ৭৪১২, ৭৪১৪, ৭৬২৮, ৭৬৩৫, ৭৬৩৬, ৭৬৪৪, ৭৬৪৫, ৭৬৫৩ ও ৭৬৫৭ দাগে ১ দশমিক ০৮৪৪ একর এবং ৯৬০১ দাগে ২ দশমিক ৩৩২০ একর ভূমি অবৈধভাবে বালু ফেলে দখল করে নিয়েছেন। দখল করা সম্পত্তি স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট মদিনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার কোম্পানির প্যাডে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন করেন। ওই আবেদনের পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় তাকে সম্পত্তি স্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়নি। পরবর্তীতে এ সম্পত্তিগুলো সংসদ সদস্যের প্রভাব খাটিয়ে তিনি দেয়াল নির্মাণ করে দখলে নিয়ে নেন। ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও সোনারগাঁও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় থেকে মদিনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাজী সেলিমকে সরকারী সম্পত্তি ছেড়ে দেয়ার জন্য নোটিস করা হয়।
×