ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

মোদির ম্যাজিকেও তেমন কাজ হচ্ছে না

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ২০ নভেম্বর ২০১৯

মোদির ম্যাজিকেও তেমন কাজ হচ্ছে না

ভারতে নরেন্দ্র মোদির মতো এত শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী এক প্রজন্মের মধ্যে আর আসেননি। তার চলন বলন, পোশাক-আশাকের মধ্যে এমন এক আস্থার ভাব মিশে থাকে যা অচিরেই অধিকতর বিলষ্ঠ ও শক্তিশালী দেশের উত্থানের সঙ্কেত নতুন করে। প-িতজনদের ধারণা কয়েক দশকের দোদুল্যমান কোয়ালিশন সরকার চলার পর ভারত আধিপত্যবাদী রাজনীতির অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এই অধ্যায়টি ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর একাদ্বয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন কংগ্রেস দলটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বিজেপি বর্তমানে যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভোগ করছে তাতে মোদি চাইলে যে কোন আইন পাস করার ক্ষমতা রাখে দলটি। প্রশ্ন হচ্ছে বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে তিনি কি এতসব দ্বন্দ্ববিরোধে জর্জরিত ভারতকে একত্রে ধরে রেখে সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন? তাঁর প্রথম মেয়াদের পুরো অধ্যায় এবং দ্বিতীয় মেয়াদের এতদিনের যাত্রাপথ পর্যালোচনা করলে ওই প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব মিলবে না। ২০১৪ সালে জাতীয় দৃশ্যপটে মোদির উত্থানের সময় অনেক ঢাকঢোল পেটানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল তিনি একজন ব্যবসায়বান্ধব বাস্তববাদী যিনি-পচন ধরা প্রশাসনকে ঝেড়ে মুছে সাফ করে ফেলবেন। অথচ মোদির প্রথম পাঁচটি বছর নানা দিক দিয়েই সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। দেশব্যাপী পণ্য ও সার্ভিস কর (জিএসটি) প্রবর্তন এবং খোলা জায়গায় মলত্যাগ বন্ধে বেশ কিছু টয়লেট স্থাপন করা ছাড়া তাঁর সংস্কারের সাহসী উদ্যোগ নীতি নির্ধারণ নিয়ে টালবাহানার মধ্যে নিঃশেষ হয়ে গেছে। বর্তমান মেয়াদে মোদিকেও তাঁর চরিত্রের আরেকটি দিক অনুসরণে অধিকতর আগ্রহী দেখা যাচ্ছে। আর তা হলো অধিকতর চাপ সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক সমস্যাবলী মোকাবেলা করার চাইতে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করা, রাজনৈতিক শত্রুদের শাস্তি দেয়া এবং হিন্দু-জাতীয়তাবাদী আদর্শের লক্ষ্যকে অনুসরণ করা। কাশ্মীরের বিক্ষুব্ধ ৭৫ লাখ মুসলমানকে কার্ফুর মধ্যে ও দিল্লীর প্রত্যক্ষ শাসনে রাখা হয়ত তারই একটা নজির। মোদি সরকার ভারতের অর্থনীতির ভাগ্যাকাশে ঘনীভূত বিপদগুলো উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এখন আশঙ্কাজনকভাবে দ্রুত মন্থরতার মোকাবেলা করতে তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ব্যাংকের নতুন সন ৮৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। প্রবৃদ্ধি ২০১৮ সালের ৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে এ বছর স্রেফ ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে ভারতের মতো এক বিশাল ও বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির দেশের জন্য এই হারটা এখনও সম্মানজনক। কিন্তু জনসংখ্যার চাপ এতই প্রবল যে ভারতকে বেকারত্বের রাশ টেনে ধরতে হলে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখতেই হবে এবং চীনের সমকক্ষতা অর্জনের আশা করলে হারের অঙ্ক আরও বেশি করতে হবে। বিশিষ্ট এক অর্থনীতিবিদের মতে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কম হলে ভারত মন্দাকবলিত হয়েছে ভাবতে হবে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ কিছু সূচক সুখকর নয়। যেমন এ বছর গাড়ি বিক্রি হঠাৎ করে পড়ে গেছে। ব্যাংক খাতে ঋণ সঙ্কট চলছে। বিদ্যুত বিতরণ কোম্পানিগুলো সঙ্কটগ্রস্ত থাকছে। ভোগ্যপণ্যের ব্যয়, পারিবারিক সঞ্চয় ও শিল্পে বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে হ্রাস পেয়েছে। শীঘ্রই এগুলি বিশ্বের অর্থনৈতিক আকাশে কালো মেঘের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিতে পারে। ভারতের বর্তমান অর্থনেতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাইরের কোন বড় কারণ থেকে সৃষ্ট নয়। আগামী কয়েক দশক দেশটির বলিষ্ঠ প্রবৃদ্ধি ঘটার মতো সম্পদ ও মেধা রয়েছে। এর সমস্যাগুলো বহুলাংশে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত। একের পর এক সরকার কি রাজ্য পর্যায়ে কি জাতীয় পর্যায়ে প্রবৃদ্ধির অনুকূল যুক্তিসঙ্গত ও সুসামঞ্জস্য নীতি অনুসরণে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। মোদি মুখে যত প্রতিশ্রুতিই দিন না কেন তিনিও এক্ষেত্রে ব্য্যর্থ হচ্ছেন। কারণ তিনি যত না সংস্কারমূলক নীতি অনুসরণ করছেন তার চেয়ে বেশি চালিত হচ্ছেন উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রবৃদ্ধির দ্বারা। ভারত দেশটিকে চালানো চাট্টিখানি কথা নয়। দেশটিতে কথ্য ভাষা প্রায় ৮শ’, রাষ্ট্রীয় ভাষা ২২টি। সমাজ ৩ হাজারেরও বেশি জাত-পাতে বিভক্ত। জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ হিন্দু সংখ্যালঘু। সামাজিক বিভাজনের সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিভাজনেরও অস্তিত্ব আছে। ভারতের পশ্চিম উপক’লে গোয়ার অধিবাসীদের মাথাপিছু আয় বিহারের তুলনায় ১২ গুণ। দক্ষিণের কেরালা ও তামিলনাড়ুর জন্মহার, সাক্ষরতা ও আয়ু থাইল্যান্ড ও তুরস্কের কাছাকাছি। আবার উত্তরের গাঙেয় সমভূমির অংশবিশেষে জন সাক্ষরতা ও আয়ুর অবস্থা আফ্রিকার সাহারা সম্মিহিত অঞ্চলের অবস্থার কাছাকাছি। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই যে প্রদেশের অন্তর্গত সেই মহারাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের অনুপাত উন্নত দেশগুলোর মতোই ১০০ শতাংশ। অন্যদিকে সর্বাধিক জনবহুল প্রদেশ উত্তরপ্রদেশে এই অনুপাত ৪০ শতাংশে আটকে আছে। বিকাশমান শহর ও অনগ্রসর গ্রামের মধ্যে যেমন বিশাল ব্যবধান আছে তেমনি একদিকে আছে গুটিকয়েক বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী যাদের হাতে পুঁজি, উন্নত প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি কেন্দ্রীভ’ত এবং অন্যদিকে আছে লাখ লাখ ছোট ছোট ফার্ম যারা বিলুপ্তির হুমির মুখে। ভারতের “প্রাতিষ্ঠানিক” অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হয়ত ২০১৮ সালে ৮ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু প্রতি চারজনের তিনজন যে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নিয়োজিত সেটির প্রবৃদ্ধি হয়ত হচ্ছে ২ শতাংশ হারে- এমনকি তা মন্দার দিকেও ধাবিত হচ্ছে। বেকারত্বের হার নির্ভরযোগ্য নয়। তবে নিঃসন্দেহে তা বাড়ছে। সাধারণ চাকরির জন্য বিপুলসংখ্যক অতি যোগ্যতাসম্পন্ন তরুণের আবেদন জমা পড়ছে। তাই দেখা যায় জীবনযাত্রার মান বাড়লেও ভারতীয়রা তেমন একটা খুশি হতে পারছে না। বৈশ্বিক কল্যাণ সূচকে ৩ শতাংশ ভারতীয় অবস্থা বিকাশমান যেখানে চীনারা হচ্ছে ২১ শতাংশ। ‘সুখের সূচকে’ ভারতীয়রা মিসর, গ্রীস কিংবা ইয়েমেনের নিচে দ্রুত তলিয়ে গেছে। মোদির প্রভাব বা মোদির ম্যাজিক সত্ত্বেও এমনটি ঘটেছে। এনামুল হক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×