ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বাজেট নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনা

নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি ছিল তার প্রতিফলন নেই

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ১৫ জুন ২০১৯

 নির্বাচনী ইশতেহারে যে  প্রতিশ্রুতি ছিল তার প্রতিফলন নেই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নতুন বাজেটকে ‘ভারসাম্যহীন’ ও ‘অসামঞ্জস্য’ উল্লেখ করে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গরিব মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করার যে প্রতিশ্রুতি ছিল, তার প্রতিফলন নতুন অর্থবছরের বাজেটে নেই। সংস্থাটি বলছে, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত নয়, যারা সচ্ছল ও উচ্চ আয়ের মানুষ তারা বাজেটের বেশি সুবিধা পাবে। যারা ‘অর্থনৈতিক অপশাসনের সুবিধাভোগী’ এবারের বাজেট তাদের পক্ষেই গেছে। পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বা অর্থনৈতিক কৌশল প্রয়োজন তা বাজেটে নেই, তা নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। এটা পরিতাপের বিষয়। প্রতিষ্ঠানটির মতে, এছাড়া অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোও বাজেটে তুলে ধরা হয়নি এবং সমাধানের কোন আভাসও নেই। বরং বাতাসের ভেতরে কিছু আশ্বাসের বাণী দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোও বাস্তবভাবে আসেনি। শুক্রবার রাজধানীর একটি হোটেলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট নিয়ে সিপিডির পক্ষ থেকে পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য। বাজেটে বেশি সুফল কারা পাবে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, এ বাজেটের মাধ্যমে সচ্ছল ও উচ্চ আয়ের মানুষরা বেশি সুবিধা পাবেন। এছাড়া গরিব মানুষের জন্য প্রান্তিকভাবে এক ধরনের ব্যবস্থা থাকছে। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত বিশেষ করে বিকাশমান মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বাজেট থেকে খুব বেশি উপকৃত হবেন না। কৃষককে ধানের লোকসানের জন্য কোন প্রণোদনা দেয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানো হয়নি। কিন্তু সম্পদের সারচার্জ সীমায় ছাড় দেয়া হয়েছে। দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জন্য আমরা কি করতে পারব- এটার ওপর নির্ভর করছে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে যাওয়ার বিষয়টি। কারণ বিকাশমান মধ্যবিত্তরাই হলো চালিকাশক্তি। চিন্তা, চেতনা, উপার্জন ও বুদ্ধিমত্তা- এগুলো সবক্ষেত্রেই চালিকাশক্তি। সেই চালিকাশক্তিকে যদি আপনি ঠিকভাবে পরিপালন না করেন, তাহলে ইশতেহারের চেতনাতো সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়বে। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ আগামীতে পৌঁছে দেয়ার যে অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, তা পূরণের স্পষ্ট কোন রূপরেখা বা কর্মসূচী এবারের বাজেটে রাখা হয়নি।’ ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ও পৃথক কমিশন গঠনের ঘোষণা না আসা প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, ব্যাংকিং খাতের সমস্যা নিয়ে বাজেটে আলোচনা আছে, কিন্তু কর্মপরিকল্পনা নেই। ব্যাংকিং খাত ও পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে এটা একদম পরিষ্কার যে, যারা এটা থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে, তারা এ পরিবর্তনগুলো আনতে দিতে চান না। তারা আসলে স্বচ্ছতা চান না। ব্যাংকিং কমিশন হলে পরে যে তথ্য উপাত্তের যে সমস্যাগুলো আছে, সেগুলো প্রকাশিত হলে কি হবে সেই দুঃচিন্তা থেকেই ব্যাংকিং কমিশন করতে দেয়া হবে না। শুধু স্বচ্ছতাকে ভয় পায় বলেই এটা করতে দেয়া হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘শুধু করের আওতা বৃদ্ধি করলে হবে না, অর্থ পাচার রোধে নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ করের টাকাতো বিদেশেও চলে গেছে। কারণ একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। তাহলে আপনি বিদেশের টাকা আটকাবেন, কালো টাকা বিনিয়োগ করতে দিবেন এটা কেমন কথা। তাহলে তো আপনার পুরোটাকে একটা সামঞ্জস্যের মধ্যে আনতে হবে। কিন্তু সবকিছুকে সামঞ্জস্যের মধ্যে আনার জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রকাশ করতে পারছেন না। কারণ সুবিধাভোগীরা নীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।’ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে জিডিপি অনুপাতে ব্যয় বৃদ্ধি না পাওয়া দুঃখজনক মন্তব্য করে দেবপ্রিয় বলেন, যারা ব্যাঙ্কক- সিঙ্গাপুরে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারে না, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পারে না, তাদের জন্য আপনি কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তাদের জন্য গণপরিবহন তৈরি হচ্ছে কি-না, তাদের শিশুরা সেরকম মানের উচ্চ শিক্ষা পাচ্ছে কিনা এটিই বড় বিষয়। তিনি বলেন, দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। কিন্তু গরিব মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে সক্ষমতা বাড়ছে না। বরং আয় বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য ও ভোগের বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যে ধরনের চাপ এ মুহূর্তে সরকারের আছে, সেই চাপের স্বীকৃতি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় নেই বলেও মনে করেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘যেহেতু সমস্যাটারই স্বীকৃতি নেই, সেহেতু উনারা কোন অভিনব কৌশল খোঁজেননি। মুদ্রানীতির ভেতরে, বাণিজ্য নীতির ভেতরে অথবা ভর্তুকি বিতরণের ক্ষেত্রে-কোন ক্ষেত্রেই সেই ধরনের অভিনবত্ব নেই। অর্থাৎ উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী যে ধরনের অভিনবত্ব দেখিয়েছেন, উনার বাজেট প্রস্তুতের এবং প্রস্তাবনার ভেতরে সেই অভিনবত্বটা আমরা দুঃখজনকভাবে খুঁজে পাইনি।’ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কি কি ছিল, সেগুলোর বিষয়ে বাজেটে কিছু আছে কিনা সেটিও তুলে ধরা হয় সিপিডির পর্যালোচনায়। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘অর্থমন্ত্রণালয় সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি ধরে এ বাজেট তৈরি করেছে বলে সিপিডি মনে করছে না। বরং গৎবাঁধা কিছু ভাল কথা থাকবে, সেই কথাগুলো আছে বাজেটে। সেই কথাগুলো যখন আছে, সেগুলোর আবার কর্মসূচী নেই।’ এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী ৩ কেটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনার কথা বলেছেন। কিন্তু কোন খাতে, কত দিনে, কতজন করে কাজ পাবে তার কোন প্রাক্কলন বাজেটে নেই। বাজেটে বলা হয়েছে করদাতার সংখ্যা ১ কোটি হবে। বলে দিলাম শীঘ্রই হবে; কিন্তু শীঘ্রই মানে সেটা কবে হবে, ২ বছর পর না ৫ বছর পর। পৃথিবীতে যে কোন কর্মসূচী যখন দেয়, সেটার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা দরকার। আপনি নির্দিষ্ট করে বলেন যে, আমি এটা নিয়ে এই অর্জন করতে চাচ্ছি। এই অর্জনের জন্য এই কৌশল নিয়েছি। এই কৌশলকে কার্যকর করার জন্য এই পদক্ষেপগুলো নিয়েছি। এটা যতক্ষণ না বলেন ততক্ষণ আমি অর্থনীতিবিদ হিসেবে আশ্বস্ত হই না। নাগরিক হিসেবে খুব খুশি হই। তবে নাগরিক ও অর্থনীতিবিদের মধ্যে পার্থক্য আছে কিন্তু। তাই বাজেটে নির্দিষ্ট করে কিছু না বলাটাও বৈষম্য।’ দেবপ্রিয় বলেন, ‘ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি অর্থনীতি তথা বৈষম্যমূলক সমাজ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। যে সমাজে অসাম্য বৃদ্ধি পায়, বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, সে সমাজ আজ হোক বা কাল হোক টিকে না। সে সমাজগুলোতে প্রবৃদ্ধি হারে পতন ঘটে। যে হারে বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে তাতে ৭, ৮, ৯ ও ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কষ্টকর হবে। এটা ঐতিহাসিকভাবে অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশতো সৃষ্টি হলো বৈষম্যের কারণে। বাংলাদেশের সংবিধানটাই হয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তাই ওই বৈষম্য যদি দেশের ভেতরে বাড়তে থাকে তাহলে আমরা আগামী দিনে কিভাবে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাব।’ বাজেট নিয়ে এনবিআর আর অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকার তফাৎ পাওয়ার কথাও তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, ‘এর ফলে বাজেটে স্বচ্ছতার অভাব থেকে যাচ্ছে। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যদি রাজস্ব বোর্ডের তথ্যগুলো ব্যবহার করেন তাহলে অবশ্যই ভাল দেখা যাবে হারগুলো। আর যদি অর্থমন্ত্রণালয়ের তথ্য ব্যবহার করেন, তাহলে হার কম দেখা যাবে। মন্ত্রী মহোদয় বোধ হয় বিচক্ষণতার সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডেরটাই ব্যবহার করেছেন।’ তথ্যের সামঞ্জস্যহীনতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ট্যাক্সের যে উৎসে কর কাটা হবে সেটার স্ল্যাবগুলো কি হবে, সেটা বাজেট বক্তৃতার ভেতরে আছে ২৫ লাখ টাকা। আর এনবিআর হিসাব দিয়েছে ১৫ লাখ টাকা। এখানে সমস্যা রয়ে গেছে। এছাড়া ফ্ল্যাট ও এ্যাপার্টমেন্ট কেনা এবং ভবন নির্মাণে বিনিয়োগের মতো অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন দেবপ্রিয়। তিনি বলেন, ‘অঘোষিত আয় ও বেআইনী আয়কে আলাদা করার সময় এসেছে। সরকারী টাকায় অবকাঠামো নির্মাণ করে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা।’ এটা অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে বলেও মন্তব্য করেন দেবপ্রিয়। সংবাদ সম্মেলনে অন্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান ।
×