ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদ বকশিশের নামে চলছে চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতা

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ৩০ মে ২০১৯

 ঈদ বকশিশের নামে চলছে চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতা

শংকর কুমার দে ॥ ঈদ যতই সামনে ঘনিয়ে আসছে ততই শুরু হচ্ছে ঈদ বকশিশ প্রতিযোগিতা। ঈদ বকশিশের আরেক নাম ঈদের উপরি আয়। আসলে এটা এক ধরনের নীরব চাঁদাবাজি। ব্যবসায়ীদের কাছে এটা এক মারাত্মক আতঙ্ক। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ক্যাডার, মস্তান, পুলিশ, কাস্টমস, ইনকামট্যাক্স, ভ্যাট, গ্যাস, বিদ্যুত, টেলিফোনসহ সেবা প্রতিষ্ঠানের সবাই এই ঈদ বকশিশ নামের নীরব চাঁদাবাজি নিয়ে এখন মহাব্যস্ত। ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শিল্পপতিরাই হচ্ছেন তাদের টার্গেট। এ ধরনের ঝামেলা এড়াতে অনেক ব্যবসায়ী লুকিয়ে থাকার কৌশল নেন। ঈদ এলেই এই উপরি আদায়ের জন্য চাঁদাবাজির নামে বকশিশ আদায়ের এই মৌসুমি চাঁদাবাজির ঘটনাটি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ হলে তারা বলেন, রাজনৈতিক নেতা, ক্যাডার মস্তানদের চাঁদা আদায়ের অজুহাত নানা ধরনের। কখনও ঈদ বকশিশের জন্য টেলিফোন করেন। মামা, চাচা বা ভাইজান সম্বোধন করে বলে ঈদ করাবেন না? নরম কথায় কাজ না হলে গরম কথায় ভয়ভীতি দেখানো হয়। যেই ব্যবসায়ী যত বড় তার কাছে বকশিশ বা চাঁদার অংকের হাঁকডাক পড়ে তত বেশি। যেই রাজনীতিক, ক্যাডার, মস্তান যত বড় তার চাঁদাবাজির নজরানাও তত বড়। ব্যবসায়ীদের অনেকেই ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে কম বেশি যা হোক একটা অংকের টাকার সমঝোতায় এসে মিটমাট করার চেষ্টা করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে হাঁফ ছাড়েন বলে জানা গেছে। পুলিশ উপরি বা বকশিশের নামে চাঁদাবাজির তালিকায় শীর্ষে। রোগ বুঝে যেমন ওষুধ তেমনি কার কাছে উপরি বা বকশিশ চাইতে হবে তা তাদের জানা। আর যদি কেউ মামলা মোকদ্দমা কিংবা কোন ঝামেলায় থাকে তাহলে তাকে নানা ধরনের প্রলোভন বা ভয়ভীতি দেখানো হয়। পুলিশের সঙ্গে কাস্টমস, ইনকামট্যাক্স, ভ্যাট, বিদ্যুত, গ্যাস, টেলিফোন, ওয়াসা, ডেসার মতো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যান এলাকাভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে। সারা বছরের সেবাদানের ওসুল তোলার জন্য একথা সেকথায় বলে অনুনয় বিনয় আবদারের সুরে আসল কথাটা বলেন, ‘আমরা ঈদের সময়ে পেয়ে থাকি’। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পুলিশ, কাস্টমস, ইনকামট্যাক্স, ভ্যাটের কর্মকর্তাদের সুর আবার একটু ঝাঁঝালো। তাদের ঝাঁঝালো সুরে থাকে ফাঁসিয়ে দেয়ার মতো প্রচ্ছন্ন হুমকির ইঙ্গিত। ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার, মস্তানরা সব সময়ই ঈদ বকশিশের নামে বাড়তি সুবিধা পায়। অবস্থা বেগতিক হলে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন স্থানে সমিতি সংগঠনের নাশে ফান্ড করে চাঁদাবাজির দাবি মিটাতে হচ্ছে। বঙ্গবাজারের কয়েক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হলে তারা জানান, রোজার ঈদের সময়ে কাপড় কেনাবেচা হয় বেশি। এ জন্য ভারতীয় কাপড়ের নামে পুলিশ ও কাস্টমসের লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। মাঝে মধ্যেই তারা হানা দেয়। অনেক সময়ে গোপনে সমঝোতা করে ফেলা হয়। সমঝোতা না হলে মিডিয়ায় চলে আসে ভারতীয় কাপড়ের চোরাচালানের আটকের ঘটনা। শ্যামপুরের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাদা পোশাকে কয়েক সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে এসে গেছেন। তাদের দাবি এবার নিজেদের কথার চেয়ে তাদের দাবি এবার বড় সাহেবদের ঈদ করাতে হবে। এবারের ঈদের বকশিশের অংকটাও একটু বেশি দেয়ার আবদারের সুরে বলে গেছেন। জুরাইন এলাকার এক ব্যবসায়ী জানান, ঈদের আগেই তারা চাঁদাবাজির শিকার। কয়েক সন্ত্রাসী এসে বলে গেছে, তাদের ঈদ করাতে হবে। এক ডাইং ফ্যাক্টরির মালিক জানান, তার কাছে সন্ত্রাসীরা এসে বলে গেছে, ঈদের সময়ে তাদের কাপড় দিতে হবে। তিনি বলেন, আমি কাপড়ের রং করি। কাপড় পাব কোথায় ? ডেমরা এলাকার রি-রোলিং মিলের এক মালিকের কাছে এক ভ্যাট অফিসার এসে বলে গেছেন, তার অফিসে দেখা করার জন্য। তিনি জানালেন, এমনিতেই ব্যবসার মন্দা। এখন ভ্যাট অফিসারের ঈদ বকশিশের দাবি মিটানো যেন গোদের ওপর বিষফোঁড়া। মালিবাগের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির এক মালিক জানালেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠিয়েছেন। দেখা করা মানেই টাকা পয়সা দেয়ার দাবি। ইনকামট্যাক্সের এক কর্মকর্তা এক কাপড়ের ব্যবসায়ীর কাছে এসে খবর নিয়ে গেছেন তিনি ইনকামট্যাক্স দেন কিনা? রাজধানীর মতিঝিলসহ অফিসপাড়াতেও একই অবস্থা। সেখানেও মস্তানদের সঙ্গে সরকারী সংস্থার লোকজনদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সকলেই একই উদ্দেশ্য ঈদের উপরি, বকশিশ। তবে গত ঈদের তুলনায় এবারের ঈদে উৎপাত একটু কম। বিশেষ করে টপটেররদের নাম ভয়ভীতি প্রদর্শনের টেলিফোনে চাঁদাবাজি আদায়ের আতংক নেই। সরকারী দলের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্যাডার, মস্তানদের চাঁদাবাজি আদায়ের কৌশল হিসাবে বকশিশ চাওয়া শুরু হয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতার ঈদ বকশিশের নামে নিরব চাঁদাবাজির কৌশলটা ব্যতিক্রমী। পরিচিত বড় ধরনের ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিদের বড়, ভাই, চাচা, মামা ইত্যাদি সম্বোধন করে এলাকার গরিব, দুঃখীদের জাকাত প্রদান, সাহায্য-সহযোগিতার করার জন্য নগদ টাকা, জামা-কাপড় দাবি করেন। যেসব ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে এ ধরনের আবদার জানানো হয় তারাও আবার ব্যবসায়িক কাজে সারা বছর ধরে রাজনৈতিক নেতাদেরও ব্যবহার করেন। ঈদের আগে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে ঈদ বকশিশ বা নীরব চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিষয়টা মিটমাট করে ফেলেন, আপনজন স্বজন ছাড়া কেউ এটা জানতে পারেন না। ফলে রাজনৈতিক নেতাদের ঈদের বকশিশ নামের নিরব চাঁদাবাজির ঘটনাগুলো বাইরে খুব একটা প্রকাশ পায় না কিংবা প্রকাশ পেলেও কেই এটা নিয়ে ঘাটাতে চান না। মতিঝিল বাণিজ্যিক পাড়ার একাধিক ব্যবসায়ী সংবাদ মাধ্যমে তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ঈদ ঘনিয়ে এলে আর অফিসে যাই না। অফিসে থাকলেই চাঁদাবাজদের আতংক। লুকিয়ে থাকি। টেলিফোনে কাজকর্ম সেরে নেই। আরেক ব্যবসায়ী জানালেন, কেউ বুঝতে যাতে বুঝতে না পারে সেই জন্য অফিস করলেও বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখি। অফিসের সহকারীরা বলে দেয়, সাহেব আসেনি। মোবাইল টেলিফোন সেইভ করা নাম্বার ছাড়া অপরিচিত নম্বরে কল ধরি না। উপরি বা বকশিশ যে যাই বলুক না কেন আসলে এটা ঈদ আসলেই শুরু হয়ে যায়, এরই নাম নীরব চাঁদা, যার নাম ঈদ বকশিশ।
×