ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন ॥ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন

শারীরিক প্রতিবন্ধী, তবুও জীবনযুদ্ধে দমে যাননি আলমগীর

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৫ মে ২০১৮

শারীরিক প্রতিবন্ধী, তবুও জীবনযুদ্ধে দমে যাননি আলমগীর

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ দুই পা আছে কিন্তু উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। তাতে কি? আত্মবিশ্বাস তো আছে। তাই তো জীবনযুদ্ধে দমে যাননি আলমগীর হোসেন। ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন তিনি। তারপর থেকে হাঁটা-চলা ও কাজকর্ম করার কথা কখনও চিন্তা করতে পারেননি আলমগীর। কিন্তু শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও জীবিকার তাগিদে রিক্সাকে বেছে নিয়েছেন হাতিয়ার হিসেবে। পঙ্গুত্ব নিয়েই তিনি নেমে পড়েন জীবনের নতুন এক যুদ্ধে যেখানে তাকে সহযোগিতা করার মতো কেউ ছিল না। ৩৫ বছর বয়সী আলমগীরের জন্মভিটা ফরিদপুর। দীর্ঘ ১৫ বছর আগে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। কারণ মা মারা যাওয়ার পর নিজ এলাকায় তাকে দেখার মতো আর কেউ ছিল না। শারীরিক অক্ষমতার কারণে বাধ্য হয়েই ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন আলমগীর। এটি ছিল তার একমাত্র রোজগারের উপায়। ভিক্ষার টাকা দিয়েই তিনি চারজনের সংসার চালাতেন। কিন্তু মানুষের কাছে হাত পেতে নেয়া অর্থ দিয়ে সংসার চালানোর মধ্যে কোন সার্থকতা নেই! এই উপলব্ধি থেকেই তিনি কিছু অর্থ জমিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা কিনে ফেললেন। বর্তমানে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে আলমগীর যাত্রাবাড়ীর মীর হাজীরবাগে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। এই রিক্সা চালানোর অর্থ দিয়েই তিনি সংসার চালাচ্ছেন, এমনকি দুই সন্তানকে লেখাপড়াও শেখাচ্ছেন। রিক্সা চালাতে কোনপ্রকার সমস্যা হয় কি-না জিজ্ঞেস করলে আলমগীর জনকণ্ঠকে বলেন, ‘দুটি পা’-এর মধ্যে একটিও নেই, কেটে ফেলতে হয়েছে। এক সময় ভেবেছিলাম ভিক্ষা ছাড়া আমার কোন গতি নেই! কিন্তু এখন বুঝেছি ইচ্ছা থাকলে মানুষ অসাধ্য জয় করতে পারে। এখন ভিক্ষা করছি না নিজের সাধ্যমত পরিশ্রম করে খাই। ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালাতে আলমগীরের তেমন অসুবিধা না হলেও অনেক সমস্যা তাকে এখানেও বাঁধাগ্রস্ত করে। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দেখে-শুনে রিক্সা চালাই। অনেক ঝুঁকিও রয়েছে শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে রিক্সা চালানোর। ট্রাফিক পুলিশরা মাঝে মধ্যেই রিক্সা আটকে দেয়। তাদের সহযোগিতা পেলে আর কোন সমস্যা হতো না।’ আলমগীর হোসেন আরও বলেন, ‘নিজের টাকায় এই রিক্সাটি কিনেছি। বিগত ৩ বছর ধরে রিক্সা চালাই। প্রতিদিন ৭০০ টাকার মতো রোজগার হয়। এই টাকা দিয়েই ঘর ভাড়াসহ ছেলে মেয়ের পড়ালেখা চালাচ্ছি। আমার ছেলে সপ্তম শ্রেণীতে ও মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে।’ বাঁচার তাগিদে স্ত্রী সন্তানের জীবন বাঁচাতে তাকে রোজ রিক্সা চালাতেই হয়। তাছাড়া ভিক্ষা করতেও সে পারবে না, ভিক্ষা করাটা তার আত্মসম্মানে বাধে বলে জানান তিনি। তাই রোজগারের একমাত্র পথ রিক্সা। কিন্তু বয়স বাড়ছে, এখন আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারেন না তিনি। আবার পরিশ্রম না করলে পেটে ভাত পড়ার কোন উপায় নেই তার! ছেলে-মেয়ে দুটির ভবিষ্যত চিন্তায় মাঝে মধ্যে হতাশা তাকে গ্রাস করছে বলে জানান তিনি। তার রিক্সাতে যেসব যাত্রী উঠেন তাদের বেশিরভাগই দয়া করে উঠেন বলে আক্ষেপ প্রকাশ করে আলমগীর জানান, ‘অনেক যাত্রী রিক্সায় উঠে খেয়াল করেন আমার পা দুটি অচল। অনেকেই এই কষ্ট দেখে অনেক দুঃখ প্রকাশ করে, আবার কেউ কেউ ভাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় না যেতেই নেমে যান। আমি কারও দয়া চাই না। আমি পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করি। ভিক্ষাবৃত্তি বাদ দিয়ে নিজে কিছু করার ব্যবস্থা করেছি। এজন্য অনেকেই আমাকে বাহবা দেন। ভিক্ষাবৃত্তি নয় বরং নিজের রোজগারেই পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন কাটাতে চাই। তবে আলমগীর আর এভাবে ঝুঁকি নিয়ে রিক্সা চালাতে চান না। অন্তত একটি চায়ের দোকান দিয়ে বাকি জীবন চলতে চান। দুই সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। তাদের মতো মানুষেরা কাজ করে খেতে চান। অন্যের সম্পদে লোভ নেই তাদের। কর্মচঞ্চল এই আলমগীরের জন্য রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব রয়েছে এনজিও ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর। দায়িত্ব রয়েছে প্রত্যেকটি সামর্থবান মানুষের। ওরা জীবন যুদ্ধে লড়াকু বীর।
×