ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সিভিল এভিয়েশনের নজরদারি না থাকায় দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৮ মার্চ ২০১৮

সিভিল এভিয়েশনের নজরদারি না থাকায় দুর্ঘটনা

আজাদ সুলায়মান ॥ দেশের ফ্লাইং ক্লাবগুলোর অব্যবস্থা ও স্বেচ্ছাচারিতার খেসারত দিচ্ছেন প্রশিক্ষণার্থীরা। সিভিল এভিয়েশনের সর্বক্ষণিক নজরদারি না থাকা ও সেফটি ইস্যুতে শিথিলতার দরুন একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। তাদের মতে-আইকাও এবং সিভিল এভিয়েশনের নিয়ম মেনে চলছেনা এসব ফ্লাইং ক্লাব। বিশেষ করে নারী পাইলটদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে যতটুকু সতর্কতামূূলক পদক্ষেপ নেয়া বাধ্যতামূলক, সেটা মানা হয়নি বলেই নারী পাইলটদের হাতেই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বিমান দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছেন নারী পাইলটরাই। ক্যাপ্টেন রোখসানা, জাকিয়া সুলতানা চমন, ডলি, ফারিয়া লারা, তামান্না ও পৃথুলা। অদক্ষ প্রশিক্ষকের সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ উড়োজাহাজে প্রশিক্ষণে বাধ্য করায় অধিকাংশ নারী পাইলটকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জেনারেল এভিয়েশন সেক্টরে এ যাবত যত দুর্ঘটনা ঘটেছে- সবকটিরই তদন্তে ফ্লাইং ক্লাবগুলোর অবহেলা ও সঠিক পরিকল্পনাকে দায়ী করা হয়েছে। সর্বশেষ রাজশাহীতে যে দুর্ঘটনায় প্রশিক্ষণার্থী তামান্না ও প্রশিক্ষক শাহেদ কামাল নিহত হন- সেটার তদন্তেও ফ্লাইং ক্লাবের সঠিক পরিকল্পনা, যান্ত্রিক ত্রুটি ও ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করা হয়েছে। ওই দুর্ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ভর দুপুরে যে সময়টাতে নিহতদ্বয়ের বিশ্রামে থাকার কথা সে সময়ে তারা ফ্লাইং করতে যান। প্রশিক্ষক শাহেদ কামাল একজন দক্ষ পাইলট হলেও তিনি মানসিকভাবে কিছুটা চাপের মুখে ছিলেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের তদন্ত চলায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। তারপরও তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওই ফ্লাইটে পাঠানো হয়। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওই দুর্ঘটনার কদিন আগেই তিনি ইজি ফ্লাই নামের একটি কার্গো কোম্পানিতে যোগ দেন। এ অবস্থায় মাত্র চার দিনের জন্য তামান্নাসহ আরও ১০ জন প্রশিক্ষণার্থীকে ‘সলো ট্রেনিং’ করানোর জন্য তিনি রাজশাহী যান। মাত্র চারদিনেই এত সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীকে সলো (এককভাবে ফ্লাই করানো) করানোর কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি বেশ অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। যে কারণে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তিনি সেদিন দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়, সে সময় শাহেদের বিরুদ্ধে একটি ঘটনার তদন্ত চলছিল। এমনিতে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। এমন অবস্থায় তাকে রাজশাহীতে গিয়ে ১০ জনকে সলো করানোর মতো কঠিন দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। এ প্রসঙ্গে যমুনা নদীতে পড়ে প্রাণ হারানো অপর পাইলট কামরুল ইসলাম সম্পর্কেও সিভিল এভিয়েশনের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন,‘তার কোন ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং প্র্যাকটিস ছিলনা। কারণ সে সময়ে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে ফুলটাইম ইন্সট্রাক্টর ছিলনা। এতে সর্বক্ষণিক ইমার্জেন্সি প্র্যাকটিস করানো হত না। কামরুল নিজেও এ প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হন। তার যদি এ ট্রেনিং থাকত তাহলে- তিনি বেশ নিরাপদেই যমুনার চরে ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে পারতেন। ওই ঘটনায় তিনি প্রাণ হারালেও তার সহযোগী পাইলট শামসুদ্দিন ভাগ্যজোরে প্রাণে রক্ষা পান । এখন তিনি একটি বেসরকারী এয়ারলাইন্সে কর্মরত। এ বিষয়ে একজন পাইলট জানান, কোন ধরনের ইন্সট্রাক্টর ছাড়া দুজন পাইলটকে এ ধরনের প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজে ঢাকা থেকে রাজশাহী পাঠানো আদৌ ঠিক হয়নি। যদিও দুজনেরই পিপিএল ( প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স) ছিল, তবুও তাদের কাছে এ ধরনের ফ্লাইং ঝুঁকিপূর্ণই ছিল । সে সময়েও বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমিতে কোন ফুলটাইম ইন্সট্রাক্টর ছিলনা। এ সব দুর্ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব একাডেমির বেশ কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে ওঠে। তদন্তকারীরা অবাক হয়েছেন- দেশের প্রধান ও প্রথম এই একাডেমির প্রধান চীফ ইঞ্জিনিয়ার রুমির কোন এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কোন ডিগ্রী নেই। উপরন্তু মাত্র অষ্টম শ্রেণী পাস এই চীফ ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র একটি ডিপ্লোমা সনদ দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করতে করতে সনাতনী কায়দায় কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জনই তার মূল যোগ্যতা। এহেন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির ওপরই ছেড়ে দেয়া হয়েছে ফ্লাইং ক্লাবের এতগুলো প্রশিক্ষণ উড়োজাহাজের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মতো গুরুদায়িত্ব। এটা তদন্তকারীদের কাছেও অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। সিভিল এভিয়েশন জানায়, অন্যান্য ফ্লাইং ক্লাবগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয় যেখানে, আইকাও ও সিভিল এভিয়েশনের নিয়মনীতি ও শর্তাদি পদে পদে লঙ্ঘন হচ্ছে। সম্প্রতি সিভিল এভিয়েশনের একটি টিম পরিদর্শনের সময় দেখতে পায় গ্যালাক্সি ফ্লাইং ক্লাব নামের একটি প্রতিষ্ঠানে গত কয়েক মাস ধরে কোন প্রশিক্ষকই নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী নজরুলের স্বেচ্ছাচারিতা, নানা অরাজকতা ও অনিয়মের প্রতিবাদে পর পর ইস্তফা দেন চীফ অব ইন্সট্রাক্টটর (সিজিআই), চীফ ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর (সিএফআই) ও হেড অফ ট্রেনিং (এইচটি)। আজও এ সব পদ শূন্য রেখেই একাডেমির কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে চালানো হচ্ছে। অথচ আইকাও এবং সিভিল এভিয়েশনের রুলস হচ্ছে এ ধরনের পদ শূন্য রেখে কিছুতেই উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের কাজ চালানো যায়না। এটা বিপজ্জনক। এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি রেখে প্রশিক্ষণ দেয়াটা প্রশিক্ষকের জন্যও নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে-প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ যেভাবে আলু-পটলের ব্যবসার মতো গায়ের জোরে ফ্লাইং ব্যবসা করছেন- তাতে খেসারত দিতে হচ্ছে যমুনা নদীতে পড়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো কামরুল ইসলামের মতো পাইলটকে। এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের ফ্লাইং ক্লাবগুলোকে প্রশিক্ষণের বিষয়ে আরও সতর্ক ও পেশাদারি হতে হবে। এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে-প্রশিক্ষণ বিমানে ফ্লাইং করার সময়ে ককপিটে বসে প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থী দুজনেই সেলফি তোলার মতো কৌতূহলী কাজেও ব্যস্ত থেকেছে। যেখানে তাদের এক মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে সেখানে তাদেরকে ককপিটে বসে মোবাইল ফোনে সেলফি তোলার মতো ছেলেমিপনা কতোটা ভয়ঙ্কর তা যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করতে না পারে তাহলে এর চেয়ে আর দুর্ভাগ্য কি হতে পারে। তিনি সিভিল এভিয়েশনকে এ সেক্টরে আরও বেশি মনোযোগী ও তদারকি বাড়ানোর পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হলে ফ্লাইং ক্লাবগুলোকে তাদের মতো করে পলিসি তৈরি করলে চলবে না। সরকারী বেসরকারী সব ধরনের ফ্লাইং ক্লাবকেই আইকাও ও সিভিল এভিয়েশনের সব শর্ত ও নিয়ম মেনে চলতে হবে।
×