ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শরীয়তপুরে টিআর কাবিটা প্রকল্পের কমিটিতে পিতা-পুত্র, ভাইবোন,স্বামী-স্ত্রী

সংস্কারের টাকা নয়ছয়

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৮ আগস্ট ২০১৭

সংস্কারের টাকা নয়ছয়

নিজস্ব সংবাদদাতা, শরীয়তপুর, ২৭ আগস্ট ॥ সদর ও জাজিরা উপজেলার গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য টিআর (টেস্ট রিলিফ) এবং কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারী বরাদ্দকৃত ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা কাজ না করেই হরিলুট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে সরকারী অর্থ আত্মসাতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য নোটিস দিয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের সরকারী টাকা হরিলুটের বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে খোদ সরকারদলীয় নেতাকর্মীরাই। প্রকল্প এলাকা শরীয়তপুর পৌরসভা, তুলাসার, বিনোদপুর, চিকন্দিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। শরীয়তপুর পৌর কাউন্সিলর আব্দুর রশিদ সরদার, জেলা যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম লিটন শেখ, এলাকাবাসী সাহানা বেগম, রাজ্জাক খান, শাহজাহান বেপারী, নুরুল হক মাদবর জানান, আমরা জেনেছি আমাদের এলাকার রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু গত ৬ মাসেও এই সকল রাস্তায় কোন কাজ হয়েছে বলে আমরা দেখিনি। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি, এম, মোজাম্মেল হক তার নির্বাচনী এলাকা সদর ও জাজিরা উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ের জন্য টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারী প্রায় ২ কোটি সোয়া ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। চলতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে তিনি এই প্রকল্পগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। এর মধ্যে ৩৮৪টি টিআর প্রকল্পের অনুকূলে এক কোটি ২৮ লাখ ৩ হাজার টাকা এবং ৩৯টি কাবিটা প্রকল্পের জন্য ১ কোটি ৯ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন । সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বরাদ্দ দেয়া প্রকল্পগুলোর অধিকাংশের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই, যা শহরের পাকা সড়ক। আর গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা নির্মাণের নামে যে সকল প্রকল্প দেয়া হয়েছে সেগুলোরও এক পয়সার কাজ করা হয়নি বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। সদর উপজেলায় মোট ১শ’ ৭৯টি টিআর প্রকল্পের প্রতিটি ৪০ হাজার ও ২৯ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া প্রকল্পগুলোর শতকরা ৮০ ভাগ প্রকল্পের কোন কাজই হয়নি। এছাড়াও ২৪টি কাবিটা প্রকল্পে ছিটেফেঁাঁটা কাজ হলেও বাকিগুলোতে হাতই দেয়া হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের নিয়ম হিসেবে প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে বিল উত্তোলনের জন্য ৫ সদস্যের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি জমা দিতে হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, টিআর প্রকল্প বাস্তবায়নে পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোনসহ পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এমনকি ফেসবুক থেকে ছবি ডাউনলোড করে ভুয়া-কাল্পনিক লোকদের নামে কমিটি তৈরি করে তা জমা দেয়া হয়েছে। আর এসব কমিটির সদস্যরা অনেকেই কমিটিতে তাদের নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি জানে না । ১৩৯ টিটিআর প্রকল্পের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দের ১৩৬ নং প্রকল্পটি হলো শরীয়তপুর পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের নীলকান্দি বাহার আলী মসজিদ থেকে দাস বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের কাজ। এ প্রকল্পটি দেয়া হয়েছে এক আওয়ামী লীগ নেতার গাড়িচালক নির্মল দাসকে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি নির্মল দাস এবং সাধারণ সম্পাদক তার বাবা গীবেন দাস। নির্মল দাস কোন কাজ না করেই সমুদয় টাকা তুলে নিয়ে গেছেন। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাজ করেছি কি না, সেটা পিআইও অফিস জানে। আমি কাজ না করলে কি আমাকে টাকা দেয়া হতো ? একই তালিকায় শরীয়তপুর পৌর এলাকার ১৩৪, ১৩৫, ১৩৭ নং প্রকল্পসহ ইউনিয়ন পর্যায়েও ৪০ হাজার টাকা করে অন্তত ১২০টি প্রকল্পের একই হাল। আর ২৯ হাজার টাকা করে দেয়া বিশেষ বরাদ্দের ১০০টি প্রকল্পে এবং সদর উপজেলার ৫০টি প্রকল্পেও দেখা গেছে একই চিত্র। এই বরাদ্দের অন্তত ৪০টিতে এক টাকার কাজও করা হয়নি। ২০০ মিটার এলাকার মধ্যে ৫-৭টি প্রকল্পের নাম দিয়ে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। একই রাস্তায় দেয়া হয়েছে একাধিক প্রকল্প। চোখের সামনে এভাবে সরকারী টাকা লুটপাটের বিষয়টি জেলাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা নির্বাহী প্রশাসন প্রতি প্রকল্প থেকে নির্ধারিত হারে কমিশন (ঘুষ) নিয়ে কোন তদন্ত না করেই সমুদয় টাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির কাছে পরিশোধ করেছেন । সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাশেম তপাদার বলেন, আমি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য বি.এম মোজাম্মেল হক আমার সঙ্গে কোন সমন্বয় না করেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। শুনেছি এবারও তিনি টিআর এবং কাবিটা প্রকল্প দিয়েছেন তার বিশেষ কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলে। এর মধ্যে তথাকথিত এক নেতাকে একাই বিভিন্ন নামে-বেনামে দিয়েছেন ৪০টি প্রকল্প। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জিয়াউর রহমান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বেগম বলেন, যে সব প্রকল্পে কোন কাজ হয়নি, সে সকল প্রকল্প কমিটির সভাপতিকে দুই দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য। যদি তারা টাকা ফেরত না দেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক মামলা করা হবে। সংসদ সদস্য বি.এম মোজাম্মেল হক মুঠোফোনে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, আমি এলাকার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প দিয়ে থাকি। এ বিষয়ে কি হয়েছে আমি ততটা জানিনা।
×