ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুদও কমানো হচ্ছে না

বাজেট ঘাটতি মেটাতে আর ব্যাংক থেকে ঋণ নয়, সঞ্চয়পত্রই ভরসা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১ আগস্ট ২০১৭

বাজেট ঘাটতি মেটাতে আর ব্যাংক থেকে ঋণ নয়, সঞ্চয়পত্রই ভরসা

এম শাহজাহান ॥ চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে আপাতত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ঘাটতি ৫৩ হাজার কোটি টাকার জন্য সঞ্চয়পত্রকে সবচেয়ে বেশি ‘নির্ভরযোগ্য’ ভরসা হিসেবে বিবেচনা করছে সরকার। এলক্ষ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদও কমানো হচ্ছে না। স্থগিত করা হয়েছে সব ধরনের ট্রেজারি বন্ড ও বিল বিক্রি কার্যক্রম। মূলত ট্রেজারি বন্ড ও বিল বিক্রি করে সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে উচ্চ সুদের বিনিময়ে ঋণ নিয়ে থাকে। এতে ব্যাংকগুলো ভাল মুনাফা করে থাকে। কিন্তু এবার ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত এই তারল্য বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। সূত্রমতে, ভ্যাট আইন কার্যকর না হওয়ায় বড় অঙ্কের বাজেট ঘাটতি হয়েছে চলতি বাজেটে। সাধারণত ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্র বিক্রির টাকা এবং ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু এবার সরকারী ফান্ডে সঞ্চয়পত্র বিক্রির পর্যাপ্ত টাকা রয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। সাধারণত সরকারের ফান্ডে টাকা থাকলে ঋণ নেয়ার কোন বিধান নেই। আর এ কারণে বাজেট বাস্তবায়নে সঞ্চয়পত্রের টাকা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে হিসেব করে দেখেছে, পুরো ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ঋণ নেয়া হলে সুদ বাবদ ব্যয় হবে সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে টাকা ধার নেয়া হলে সুদ বাবদ সামান্য কিছু টাকা কমলেও বরং তা সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। বেসরকারী খাতের ঋণপ্রবাহ কমে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, ইতোপূর্বে যখনই সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে তখনই হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে সুশীল সমাজ। ব্যাংকগুলোও সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। একটি স্বস্তিদায়ক সুদহার নির্ধারণ এবং বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, ভ্যাট আইন কার্যকর না হওয়ায় যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা নিয়ে সরকার মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। বরং ঘাটতির চেয়ে বেশি টাকা এখন সরকারের ফান্ডে রয়েছে। নিয়মানুযায়ী সরকারের ফান্ডে টাকা থাকলে ঋণ নেয়া যায় না। আর এ কারণেই ট্রেজারি বন্ড ও বিল বিক্রি কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষার রক্ষাকবচ হিসেবে সঞ্চয়পত্রকে বিবেচনা করা হয়। হঠাৎ করে এ খাতের সুদ কমানো হলে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ইতোমধ্যে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে দেখা গেছে, সিংহভাগ মানুষই পেনশনার এবং পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মালিক। তারা সঞ্চয়পত্রের লাভের ওপর সংসার চালাচ্ছেন। এই বাস্তবতায় সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো যাচ্ছে না। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদ বেশি হওয়ায় পুরো অর্থনৈতিক সিস্টেমে কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে। আমরা সেই চাপ কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। ট্রেজারি বন্ড ও বিল বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিদিনের ব্যয় মেটাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সরকার ট্রেজারি বন্ড ও বিল বিক্রি করে থাকে। বন্ড ও বিল কেনার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে সুদ পায়। বরাবরই ব্যাংকগুলোর জন্য নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ট্রেজারি বন্ড ও বিল বিবেচিত হয়ে আসছে। বাজেট ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বছরের কোন সময়ে এবং কোন ব্যাংকের কাছ বন্ড ও বিল বিক্রি করা হবে তা চূড়ান্ত করা হয়ে থাকে। চলতি বাজেটেও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এ ধরনের লেনদেনের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু সরকারের ফান্ডে টাকা থাকায়, এই ঋণের আর প্রয়োজন হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে তিন মাস থেকে ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড চালু রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে বিলসহ সরকারের বেশ কিছু ট্রেজারি বিলও চালু রয়েছে। দেশের প্রাইমারি ডিলার (পিডি) ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি নন-পিডি ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব বন্ডের ক্রেতা। এসব বন্ড ও বিলের বিপরীতে সুদহার কলমানি সুদের হারের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি বন্ডের অকশনের তালিকায় এই বন্ডের অকশন সিডিউল যোগ করা রয়েছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ২৩ হাজার কোটি ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা ছিল। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় গত অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে উল্লেখযোগ্য কোন ঋণ নেয়া হয়নি। আর এবার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ না নেয়ার জন্য বন্ড ও বিল বিক্রি স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। অনলাইনে আনা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কার্যক্রম সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানো না হলেও এ খাতের বিনিয়োগকারীদের পর্যবেক্ষণে পুরো কার্যক্রম অটোমেশন পদ্ধতিতে করা হবে। এলক্ষ্যে অনলাইনে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কার্যক্রম এবং ক্রেতাদের যাবতীয় তথ্যাদি অনলাইনে সংগ্রহ করা হবে। ইতোমধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদের টাকা অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাংক হিসেবে দেয়ার পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, পেনশনার ও পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনতে বেশি উৎসাহিত করা হবে। বড় উদ্যোক্তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ যাতে এখাতে না আসে সেজন্য ক্রেতাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। অর্থসচিব আরও জানান, পারিবারিক ও পেনশনারদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রের বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। সারাজীবনের সঞ্চয় এখানে যারা বিনিয়োগ করছেন তাদের স্বার্থ অবশ্যই দেখা হবে। তবে বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য সঞ্চয়পত্র নয়। তারা অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করবেন। সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্রকে বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই এ খাতে কারা বিনিয়োগ করছেন, কেন করছেন তাদের বিষয়ে সরকার অবগত থাকবে।
×