ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যালারিতে প্রদর্শনের অপেক্ষায়

সংগ্রাহকদের সচেতন উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ সংগ্রহ জাদুঘরে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২৬ জুলাই ২০১৭

সংগ্রাহকদের সচেতন উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ সংগ্রহ জাদুঘরে

মোরসালিন মিজান মুক্তিযুদ্ধের বিপুল ক্যানভাস। অজস্র নিদর্শন। সারা দেশে ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু ইতিহাস সচেতনতার অভাবে অনেক কিছ্ইু সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করা হয়নি। ফলে বহু অমূল্য স্মারক চিরতরে হারিয়ে গেছে। সেই বেদনার জায়গা থেকে শূন্যতার জায়গা থেকে দেখলে সম্প্রতি পাওয়া নিদর্শনগগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলতেই হবে। আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে গত ১৮ মে এসব নিদর্শন জাতীয় জাদুঘরকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন কয়েকজন সংগ্রাহক। সচেতন সংগ্রহ ও দীর্ঘকাল ধরে সংরক্ষণ করার পর তাদের এই স্বত্ব ত্যাগ। একই দিন আরও বেশ কিছু নিদর্শন গ্রহণ করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। তবে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শনগুলো নিয়ে আছে বিশেষ কৌতূহল। প্রথমেই বলা যায়, কামানের গোলার দুটি খোলসের কথা। উচ্চতায় এগুলো ৪৯ সেমি। রংটা আগের মতো নেই। লাল রং করা হয়েছে। সংগ্রাহক মাহবুব উদ্দিন আহমেদ ঢাকার গোলাপবাগের বাসিন্দা। ১৯৭১ সাল থেকে এখানে আছেন। নিদর্শন সংগ্রহের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, গোলাপবাগের যেখানে এখন পুলিশ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, তার ঠিক উল্টা দিকে দুটি মাঠ ছিল। ফুটবল খেলার মাঠ। কিন্তু এগুলোকে ময়লা আবর্জনার ভাগারে পরিণত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় আবর্জনার সঙ্গে আরও আসতো বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি, যুদ্ধাস্ত্র, কামানের গোলা, মর্টার শেলসহ নানা কিছু। অনেক দিন এসব পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এমনকি বাঙালীদের মেরে এখানে লাশ ফেলে রেখে যেত পাকিস্তানীরা। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। কৌতূহল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। যা কিছু অন্যরকম মনে হয়েছে তাই কুড়িয়ে ঘরে এনেছি। শেষ পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল কামানের গোলার দুটি খোসা। মজার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, এগুলোর ভেতরে বৈদ্যুতিক বাল্ব লাগিয়ে টেবিল ল্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেছি আমি। পরবর্তীতে এর গুরুত্ব অনুধাবন করি। তাই জাদুঘরে হস্তান্তর করা। জাদুঘরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত একটি ট্রানজিস্টার রেডিও। এটির সংগ্রাহক মির্জা মোঃ মাহবুবুল ইসলাম। তিনি জানান, ১৯৬৫ সালের দিকে রেডিওটি ক্রয় করেছিলেন তার বড় ভাই টিএনটি বোর্ডের ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার এস এম মোজাম্মেল হক। তারপর থেকে এটি ছিল পারিবারিক বিনোদনের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু ১৯৭১ সালে বদলে যায় সব। দুই ভাইসহ পরিবারের সবাই আশ্রয় নেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। খুব কিছু তারা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু সনি কোম্পানির তৈরি রেডিওটি আকারে খুব বড় ছিল না। ২৩ বাই ১৪ সেমি। সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় তারা এটি সঙ্গে নিয়ে যান। যুদ্ধের সর্বশেষ খবর জানতে রেডিওটিতে কান পেতে থাকতেন সবাই। স্মৃতি হাতড়ে মাহবুবুল ইসলাম বলেন, স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে যত অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে তার সবই এই রেডিওতে আমরা শুনেছি। সেই আবেগঘন দিনগুলোর কথা কোন দিন ভুলা যাবে না। এ কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও স্মারকটি আমি সংরক্ষণ করি। এ পর্যায়ে এসে মনে হয়েছে রেডিওটি সংরক্ষণের উত্তম জায়গা জাতীয় জাদুঘর। তাই এখানে দেয়া। একই ব্যক্তি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছেন দুর্লভ রেশন কার্ড। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশী শরণার্থীদের মধ্যে এই কার্ড বিতরণ করা হতো। কার্ড দেখিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করতেন শরণার্থীরা। অসংখ্য কার্ডের একটি ইস্যু করা হয়েছিল মাহবুবুল ইসলামের বাবা মির্জা মোঃ মকবুল হোসেনের নামে। পরিচয় পত্রের মতো দেখতে। কাগজের স্মারক। বহুকালের পুরনো। এরপরও সুন্দর সংরক্ষণ করা হয়েছিল। তাই কিছু লেখা এখনও পাঠযোগ্য। কার্ডের উপরের অংশে লেখা রয়েছে ‘রামকৃষ্ণ মিশন।’ নিচে ‘পূর্ববঙ্গ শরণার্থী সেবাকেন্দ্র।’ কার্ডটি থেকে জানা যায়, এটি দেখিয়ে ৬ জন পুরুষ, ৭ জন নারীসহ কয়েকজন শিশুর খাবার সংগ্রহ করা হতো। সেই স্মৃতি হাতড়ে ধরে মাহবুবুল ইসলাম বলেন, প্রতি শনি ও মঙ্গলবার কার্ডটি নিয়ে ক্যাম্পে যেতাম আমি। ১২ থেকে ১৩ মাইল দূরের ক্যাম্প। বাইসাইকেল চালিয়ে যেতে হত। ফিরে আসতাম চাল ডাল আলু ইত্যাদি নিয়ে। কার্ডটি সেই ইতিহাসের স্মারক বলে জানান তিনি। জাদুঘরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বেশ কিছু নতুন দলিল নথিপত্র ও চিঠি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে লেখা দুর্লভ একটি চিঠি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য চিঠিতে রয়েছে মহান নেতার স্বাক্ষর। স্বাক্ষর সংবলিত চিঠিটি জাদুঘরে প্রদান করেছেন দিনাজপুরের রেজাউল করিম। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নিজের হাতে লেখা একাধিক চিঠি উপহার হিসেবে পাওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে এই দেশপ্রেমিক লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। সেখানে বিশ্ব জনমত গঠন ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল গঠনের কাজ করতেন। অর্থ সহায়তা চেয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠের কাছে চিঠি লিখেন তিনি। প্রাপকদের একজন ছিলেন মনজুরুল হক। একাধিক চিঠি ও সংশ্লিষ্ট দলিল জাদুঘরে হস্তান্তর করেছেন তিনি। চিঠি পাঠে জানা যায়, মনজুরুল দুবাই থেকে অর্থ সংগ্রহ করে লন্ডনে পাঠাতেন। আছে আরও অনেক অজানা তথ্য। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় কানাডা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল একটি দুর্লভ পোস্টার। ৪২ বাই ২৭ সেমি পোস্টার জাদুঘরে উপহার দিয়েছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা এনাম-ই-খোদা। এই পোস্টারটি জানাচ্ছে, তারিক আলী নামের এক পাকিস্তানী নাগরিকও বাঙালীর স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন! জাদুঘরের সাবেক কিপার ড. মোঃ আলমগীরের সংগ্রহ থেকে পাওয়া গেছে ১৯৭১ সালে মুদ্রিত একটি লিফলেট। ওই লিফলেট বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যার কথা জানিয়ে পাকিস্তানী পশু শক্তিকে পরাজিত করার আহ্বান জানানো হয়। জাদুঘরের আরেক সাবেক কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম দুটি প্রভাবশালী বিদেশী পত্রিকার ক্লিপিংস উপহার দিয়েছেন। একটি টাইম ম্যাগাজিনের দুর্লভ সংখ্যা। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংখ্যায় বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের খবর। একাধিক ছবিসহ শিরোনাম Bangladesh: Out of War, a Nation is Born অন্যটি ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত নিউজ উইক। এখানে ছবিসহ শিরোনাম-THE BIRTH PANGS OF BANGLADESH. অন্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে রমনী মোহন দাসের ব্যবহার করা পরিচয়পত্র ও অন্যান্য দলিল। মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মারক জাদুঘরে প্রদান করেছেন নির্মল কান্তি দাস। মুক্তিযুদ্ধের নতুন সংগ্রহ সম্পর্কে জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, উপহার পাওয়া সবগুলো নিদর্শনই দুর্লভ। অমূল্য। নিদর্শনগুলো নিয়ে আরও কাজ করবে জাদুঘর। এর পর সংরক্ষণ বা গ্যালারিতে প্রদর্শনের উদ্যোগ নেয়া হবে। উপহারদাতাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
×