ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

দীপন ও নীলাদ্রি হত্যার আসামি ফাহিম গ্রেফতার

ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যাকাণ্ড মেজর জিয়ার নির্দেশে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৩ নভেম্বর ২০১৬

ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যাকাণ্ড মেজর জিয়ার নির্দেশে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যার অন্যতম আসামি খাইরুল ইসলাম ফাহিমকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ফাহিম জামিল, রিফাত ও জিসান নামেও পরিচিত। ফাহিম নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক কমান্ডার সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হকের সরাসরি নির্দেশনায় প্রকাশক দীপন ও ব্লগার নিলয় হত্যায় জড়ায়। ফাহিম নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা শাখার সদস্য। তার কাজ ছিল দীপন ও নিলয় সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা। তার দেয়া সঠিক তথ্য মোতাবেক দীপন ও নিলয়কে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের দুটি সিøপার সেল সফলভাবে হত্যা করতে সক্ষম হয়। দুটি অপারেশন সফল করতে সবমিলিয়ে প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছে তাদের। অপারেশন দুটি ৪ মাসেই শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু নিলয় বাসা পরিবর্তন করায় তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নতুন করে সংগ্রহ করতে আরও দুই মাস লেগে যায়। নতুবা চার মাসের মধ্যেই দু’জনকে হত্যা করা সম্ভব ছিল। ফাহিমের বরাত দিয়ে ডিবি পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত দেশে যত প্রকাশক, লেখক ও ব্লগার হত্যা হয়েছে, তার সবই ঘটেছে পুরস্কার ঘোষিত মেজর জিয়ার সার্বিক নির্দেশনায়। জিয়ার নির্দেশে তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা দীপন ও নিলয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক এবিটির একেকটি সিøপার সেল হত্যাকা-ের ঘটনাগুলো ঘটায়। ডিবির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে ব্লগার, লেখক, প্রকাশক হত্যার সঙ্গে আরও তিনজনের জড়িত থাকার তথ্য মিলেছে। ওই তিনজন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনটির কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য। তারা ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবেও পরিচিত। তারা তিনজনই তিনটি খ্যাতিমান মাদ্রাসার শিক্ষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত। এই তিনজনই এবিটির তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা শাখার দেয়া তালিকা মোতাবেক কাদের হত্যা করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। শূরা কমিটির বৈঠকে সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে তালিকার মধ্য থেকে কাদের হত্যা করা হবে, তাদের বাছাই করে আলাদা তালিকা করে। যাদের শূরা কমিটি ইসলামের শত্রু বলে আখ্যা দিয়ে তাদের কতল করার নির্দেশ দেন, শুধু তাদেরই হত্যা করা হয়। শূরা কমিটির এমন নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেন মেজর জিয়া। শুক্রবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদের সার্বিক নির্দেশনায় রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গ্রেফতার করা হয় ব্লগার নিলয় ও প্রকাশক দীপন হত্যার অন্যতম আসামি ফাহিমকে (২৪)। শনিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার আব্দুল বাতেন আরও জানান, গ্রেফতারকৃত ফাহিম প্রকাশক দীপন (৪০) ও নিলয় (৩৫) হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। ফাহিমের সঙ্গে ২০১৩ সালে বড় ভাই হিসেবে মেজর জিয়ার পরিচয় হয়। তাঁর মাধ্যমেই সে এবিটিতে যোগ দেয়। সে ২০১৪ সাল থেকে এবিটির তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা শাখার হয়ে কাজ করে আসছিল। তার দায়িত্ব ছিল ইন্টারনেটে টার্গেটকৃতদের উপর নজরদারি করা। তথ্য বিশ্লেষণ করা। সম্ভাব্য টার্গেটের বিষয়ে মেজর জিয়াকে জানাত। সেই তথ্য এবিটির শূরা কমিটির বৈঠকে ওঠে। শূরা কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং মেজর জিয়ার নির্দেশে দীপন ও নিলয়কে হত্যা করে এবিটির পৃথক সিøপার সেল। যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের আশকারী গ্রুপের সদস্য বলা হয়। আব্দুল বাতেন আরও জানান, দেশে কয়েক বছরে যত লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রত্যেকটিরই নির্দেশদাতা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষিত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়ার নির্দেশে। মেজর জিয়া ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনা অভ্যুত্থানে প্ররোচনা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর চাকরিচ্যুত হন। এরপর থেকেই সে পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাকে ধরিয়ে দিতে পুলিশ সদর দফতর ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ডিবির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ফাহিম তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা শাখার সদস্য। তাদের সার্বিক পর্যালোচনায় এবং শূরা কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক হত্যার টার্গেট করা হয় দীপন ও নিলয়কে। সব মিলিয়ে ছয় মাস সময় লেগেছে দু’জনকে হত্যা প্রক্রিয়া শেষ করতে। মূলত দুই জনের জন্য সবমিলিয়ে চার মাস সময় ধরেছিল তারা। কিন্তু নিলয় বাসা পরিবর্তন করায় এবং ফেসবুকসহ অন্যান্য তথ্য প্রযুক্তির সংস্পর্শে না থাকায় দুই মাস সময় বেশি লেগেছে। নতুন বাসার ঠিকানা যোগাড়, জায়গা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, অপারেশন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা, বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দাদের সম্পর্কিত নানা তথ্য ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে দুই মাস সময় বেশি লেগে যায়। ফাহিমের বরাত দিয়ে এই কর্মকর্তা আরও জানিয়েছেন, ফাহিমের নির্ভুল তথ্য প্রদানের কারণে দীপন ও নিলয়কে সফলভাবে হত্যা করতে পেরেছে এবিটির দুটি আশকারী বা সিøপার সেল। ফাহিম যাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে, তাদের মধ্যে দীপন ও নিলয়ের হত্যাকা- সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আরও অনেকের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছিল ফাহিম। যাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করছিল, তাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে। প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনার নিজ অফিসেই দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (বর্তমানে আনসার আল ইসলাম নামে তৎপর) খুনের দায় স্বীকার করে। একই বছরের ৭ আগস্ট রাজধানীর গোড়ানে নিজ বাসায় মুক্তমনা ব্লগের লেখক নিলয়কে দুপুরে কুপিয়ে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একটি সিøপার সেল। ওই দিনই এ হত্যার দায় স্বীকার করে জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ (একিউআইএস) শাখার নামে বিবৃতি দেয়া হয়। এ হত্যাকা-ের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বেশ কয়েক গ্রেফতার হয়। ডিবি সূত্রে জানা গেছে, দীপন ও নিলয় হত্যায় এবিটির পাঁচ জন করে অংশ নিয়েছিল। দীপন হত্যার দিনে মোহাম্মদপুরে শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে হামলা চালায় এবিটির আরেকটি দল। ওই ঘটনায় চলতি বছরের ১৫ জুন শুদ্ধস্বর প্রকাশনার প্রকাশক আহমেদ রশীদ টুটুলসহ তিন জনকে হত্যা চেষ্টায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী পুরস্কার ঘোষিত মোঃ সুমন হোসেন ওরফে শাকিব ওরফে শিহাব ওরফে সাইফুল গ্রেফতারের পর সিফাত নামে আরও এক এবিটি সদস্যের নাম আসে। শিহাব আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যাকা-ের সঙ্গে সিফাত এবং সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার নাম প্রকাশ করে। গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হত্যাকা-ের শিকার হওয়া মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞান মনস্ক লেখক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক প্রকৌশলী ড. অভিজিৎ রায়ের লেখা ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ ও ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ নামের দুটি বই প্রকাশিত হয়। বই প্রকাশ করায় হত্যা করা হয় দীপনকে। চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ডিবি পুলিশের হাতে টঙ্গী থেকে গ্রেফতার হয় জঙ্গী আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে সাদ। পরবর্তীতে সাদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ডিবি সূত্র বলছে, অভিজিৎ রায়ের লেখা বই প্রকাশ করায় শুদ্ধস্বর ও জাগৃতি প্রকাশনার মালিকরা হত্যার টার্গেটে পরিণত হন। দুইটি প্রকাশনার মালিকদের হত্যার জন্য দুটি সিøপার সেল গঠন করা হয়। প্রতিটি সিøপার সেলে পাঁচজন করে রাখা হয়। সিøপার সেল দু’টির প্রাথমিক প্রশিক্ষণ হয় চট্টগ্রামে। পরে তাদের গাজীপুরের টঙ্গীতে পাঠানো হয়। টঙ্গীর বর্ণমালা সড়কের একটি বাড়িতে সিøপার সেল দুটির প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরপর সেল দুটির একটিকে পাঠানো হয় ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি জঙ্গী আস্তানায়। এই আস্তানায় থাকা সিøপার সেলের পাঁচ সদস্য মোহাম্মদপুরের শুদ্ধস্বর প্রকাশনায় হামলা চালায়। সিøপার সেলটির সদস্যরা আগ থেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। আর রাজধানীর মহাখালীর একটি জঙ্গী আস্তানায় পাঠানো হয় দীপন হত্যায় গঠিত সিøপার সেলটিকে। ওই সেলটি অতটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। তাদের মহাখালীর আস্তানায় সবুর প্রশিক্ষণ দেয়। সেই প্রশিক্ষণে অন্য সামরিক কমান্ডারাও ছিল। সেখানে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ শেষে একই সময়ে দুটি সেল দুটি অপারেশনে যায়। মহাখালীর আস্তানায় থাকা সেলটি জাগৃতি প্রকাশনীতে হামলা চালায়। হামলায় অংশ নেয়া পাঁচ জনের কাছেই পাঁচটি চাপাতি ছিল। শুধু একজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। দীপন হত্যার অপারেশনের মূল দায়িত্ব পালন করে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী সিফাত। দুটি অপারেশন শেষে দুটি সেলের সঙ্গে আবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয়। সূত্রটি বলছে, হত্যাকারীদের আরেকটি জঙ্গী আস্তানা ছিল যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায়। সেই আস্তানায়ও প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেখানে সাগর নামে একজন প্রশিক্ষণ দিত। যাত্রাবাড়ীর আস্তানায় টার্গেটকৃত অন্য আরও দুইজনকে হত্যার জন্য আরও কয়েক জঙ্গীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। দীপন ও জাগৃতি প্রকাশনায় অংশ নেয়া এবিটি সদস্যরা সেই মাদ্রাসায় যায়। সেখানেই অস্ত্রগোলাবারুদ জমা দিয়ে যে যার মতো অন্যত্র চলে যায়। দীপনকে সফলভাবে হত্যা করায় যাত্রাবাড়ীর আস্তানায় শুকরিয়া আদায় করে বিশেষ মোনাজাত, দোয়া, নামাজ আদায় ও মিষ্টি খাওয়া হয়। আর মোহাম্মদপুরের অপারেশন সফল না হওয়ায় রীতিমতো সমালোচনা করা হয় অংশ নেয়া এবিটি সদস্যদের। মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দীপন হত্যায় পাঁচজন অংশ নিয়েছিল। হত্যাকারীদের ট্রেনিং দিয়েছিল পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত এবিটির মাঠ পর্যায়ের সামরিক কমান্ডার (মাসুল) শরীফ ও সাদ। হত্যাকা-ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শুধুমাত্র সিফাত গ্রেফতার হয়েছে। সিফাতের দেয়া তথ্য মোতাবেক বাকি চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। আর হত্যায় তথ্য দিয়ে সহযোগিতাকারী ফাহিম গ্রেফতার হয়েছে। ফাহিম আরও টার্গেটকৃতদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছে। তা যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। মেজর জিয়া গ্রেফতার হলেই শূরা কমিটি সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট তথ্য জানা যাবে। সংবাদ সম্মেলনে ডিবির মিডিয়া ও পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান, সাজ্জাদুর রহমান ছাড়াও উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×