কাজু ও কফিতে নতুন স্বপ্ন
পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির আলুটিলা পাহাড়ে প্রায় ৮ একর পতিত জমিতে কাজুবাদাম ও কফির বাগান গড়ে তুলেছেন সঞ্জয় দেবনাথ। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে মিশ্র ফল বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফলের আবাদ করে আসছেন তিনি। আম ও লিচুতে মুনাফা কম হওয়ায় কাজুবাদাম ও কফি চাষে ঝুঁকেছেন পেশায় চাল ব্যবসায়ী সঞ্জয়। বাগান গড়ে তোলার এক বছরের মধ্যেই ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে কাজুবাদামের গাছগুলো।
অধিক ফলন পেতে প্রথমবছরের ফুল ভেঙে দেওয়া হয়েছে ছোট চারা গাছগুলোর। তবে পরীক্ষামূলকভাবে ফুল রেখে দেওয়া গাছগুলোতে এরই মধ্যে বেশ পরিপক্ব হয়ে উঠেছে কাজুবাদাম। সেগুলো খেতে বেশ সুস্বাদুও। আর আগামী বছর থেকেই স্বল্প পরিসরে কাজুবাদাম বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন তিনি। আর কফি গাছগুলোতেও উঁকি দিচ্ছে সম্ভাবনার ফুল। আশাবাদী এই কৃষক কাজু ও কফি চাষে নতুন স্বপ্ন বুনছেন। সাফল্যের হাতছানি দেওয়া বাগানটিকে আরও বড় করার স্বপ্নও তার।
দেশে কাজুবাদাম ও কফির আবাদ বাড়াতে কয়েক বছর আগে ‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন এ প্রকল্পের আওতায় চলছে প্রদর্শনী, দেওয়া হচ্ছে নানা সহায়তা। ২০২১ সালের জুনে শুরু হওয়া পাঁচ বছরমেয়াদি এই প্রকল্পটির কাজ ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় পার্বত্য অঞ্চলের তিন জেলার ২৫টি উপজেলাসহ অন্যান্য উপযোগী এলাকায় কফি ও কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাত এবং বিপণনের মাধ্যমে কৃষকের আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং আর্থ সামাজিক অবস্থার টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য রয়েছে। পাহাড়ের অনাবাদি জমিকে আবাদযোগ্য করে তোলাও এই প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। এই প্রকল্পের আওতায় চারা ও সারসহ বিভিন্ন সহায়তা পেয়ে আসছেন খাগড়াছড়ির সঞ্জয় দেবনাথও।
সঞ্জয় দেবনাথ বলেন, ‘গেল বছর প্রায় ৮ একর জমিতে কাজু বাদাম ও কফির চারা লাগিয়েছি। এ বছরই ফুল এসেছে। কাজু ও কফির খুব ভালো পজিশন। আবাদ খুব ভালো হয়েছে। বাগান দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। এক বছরের মধ্যে বাগানটি খুব গর্জিয়াস হয়ে উঠেছে।’ তিনি বলেন, ‘বাগানে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি কাজু ও কফির চারা লাগিয়েছি। উভয় ফলের গাছ রয়েছে প্রায় ৫ হাজার করে। চারা গাছগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫০টি কাজু বাদামের চারা মারা গেছে।
বাগানের গাছগুলো খুবই সবুজ ও সতেজ। দেখলে মন জুড়িয়ে আসে।’ নোয়খালীর আদি বাসিন্দা সঞ্জয় আরও বলেন, ‘২০০৬ সালের দিকে আমি খাগড়াছড়িতে আসি। প্রায় ২৭ লাখ টাকা দিয়ে ২৩ একর জমি কিনি। ২০০৭ সাল থেকেই এই জমিতে মিশ্র ফল বাগান গড়ে তুলেছি। প্রথম থেকেই আম ও লিচুর বাগান করে আসছি। আমি পামের (পাম ওয়েল) চারাও লাগিয়েছিলাম। পামে প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। আম ও লিচুতেও তেমন মুনাফা আসছেনা।
পরে স্থানীয় কৃষি অফিসের সহায়তা ও পরামর্শে কাজুবাদাম ও কফির বাগান গড়ে তুলেছি। স্থানীয় কৃষি অফিস ও প্রকল্পের পক্ষ থেকেই বেশির ভাগ চারা দেওয়া হয়েছে। অল্প কিছু চারা আমি কিনেছি। প্রকল্পের পক্ষ থেকে সার ও অন্যান্য উপকরণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।’
বর্তমানে সঞ্জয় দেবনাথের কাজু ও কফির বাগানে ৪ জন শ্রমিক কাজ করছেন। প্রত্যেক শ্রমিকের দৈনিক বেতন ৮০০ টাকা। সঞ্জয় বলেন, ‘বাগান করায় স্থানীয় কয়েকজনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কাজু ও কফি বাগানে ৪ জন শ্রমিক ও মিশ্র বাগানের জন্যে ২ জন শ্রমিক রয়েছেন। শ্রমিকদের মাসিক বেতন প্রায় ৭২ হাজার টাকা। কাজু ও কফির ৮ একর জমিতে এখন পর্যন্ত ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাগানে যে যায়গা আছে সেখানে আরও ৪ হাজার চারা লাগানো যাবে।
আশা করি আগামী বছর সেই চারাগুলো লাগাতে পারব। আর আগামী বছর বাগান থেকে স্বল্প পরিসরে কাজুবাদাম পাওয়া যাবে বলে প্রত্যাশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, পাহাড়ি এই বাগানের নিচে পানি রয়েছে। শ্রমিক দিয়ে সেখান থেকে পানি উঠাতে হচ্ছে। সেচ কাজের জন্যে একটি পাম্পের ব্যবস্থা করে দিলে বাগানের গাছগুলো আরও সতেজ ও সবুজ হয়ে উঠবে। সেচের অভাবে কোনো গাছই আর তখন মারা যাবে না। সঞ্জয় দেবনাথ আরও বলেন, এই এলাকায় আমিই প্রথম কাজুবাদাম ও কফির বাগান করেছি।
২৭ একরের বেশিরভাগ জমিতে মিশ্র ফল বাগান করে আসলেও আমি তেমন লাভের মুখ দেখছিলাম না। লোকসানই বেশি হচ্ছিল। নতুন স্বপ্ন বুনেই কাজুবাদাম ও কফির বাগান গড়ে তুললাম।’ তিনি বলেন, ‘এক বছরের মধ্যেই কাজুবাদাম ও কফির গাছে ফুল আসায় এই বাগান আমাকে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। কাজুর সঙ্গে সঙ্গে কফি গাছেও ফুল এসেছে। আরও ৬ মাস লাগবে ফুলগুলো বড় হতে। পরে সেই ফুলগুলো ভেঙে দেব।
নতুবা পরবর্তীতে ভালো ফল পাওয়া যাবেনা। আমার বাগান দেখে এলাকার অনেকই এখন অনুপ্রাণিত হচ্ছে। তারাও কাজু ও কফি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছে।’
জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুক্তা চাকমা বলেন, ‘খাগড়াছড়িতে আমরা কাজুবাদাম ও কফির প্রায় ১০০ প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করেছি। আমরা বাগানগুলোতে বাণিজ্যিক ও জাত প্রদর্শনী করেছি। বাগানগুলোতে জাত প্রদর্শনী হিসাবে ৮০টি ও বাণিজ্যিক প্রদর্শনী হিসাবে ৬২৫টি কাজুবাদামের চারা দিয়েছি।
আর জাত প্রদর্শনী হিসাবে কফির ১৩৫ টি ও বাণিজ্যিক প্রদর্শনী হিসাবে ১ হাজার ১২৫ টি চারা দিয়েছি। এর মধ্যে কফির বেশ কিছু চারা মারাও গিয়েছে। সেখানে আবার নতুন চারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তবে মারা যাওয়া স্থানগুলোতে কফির চারা এখনো পরিপক্ব হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘কফিতে দুইবার ফুল হয়। আশা করি এবার ভালো ফলন আসবে। কফির ভালো ফলন পাওয়া যাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এরই মধ্যে বেশিরভাগ কাজুবাদামের বাগানে ফুল এসেছে। ফলন এখন শুরু হয়নি। দুই একটা গাছে ফল এসেছে। কাজুবাদাম ভালো পজিশনে আছে। কফির চেয়ে কাজুবাদামের গ্রোথ বেশ ভালো।’
এই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের এই এলাকাটি পর্যটননির্ভর। এরই মধ্যে কৃষকরা কফিশপ খোলার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কাজুবাদাম ও কফি প্রসেসিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে এই অঞ্চলে কাজু ও কফি চাষ বেশ সম্ভাবনময় হয়ে উঠবে। এলাকাটিতে কাজুবাদাম ও কফি চাষ আরও বেশি হারে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
‘কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শহীদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাজুবাদাম ও কফি আবাদ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। প্রকল্পের আওতায় পাহাড়ি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজুবাদাম ও কফির আবাদ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কৃষকরাও খুব আগ্রহ প্রকাশ করছেন। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় চাহিদা মেটানো পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদেশী কাজুবাদাম ও কফি রপ্তানির সম্ভাবনাও রয়েছে। আমরা সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলছি।’