ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীর শতাধিক ক্যাসিনো বন্ধের নির্দেশ

প্রকাশিত: ১১:০৪, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯

রাজধানীর শতাধিক ক্যাসিনো বন্ধের নির্দেশ

শংকর কুমার দে ॥ বুধবার থেকে রাজধানীর ক্যাসিনো বন্ধে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। ঢাকার ৫০ থানার ৮ জোনের শতাধিক ক্যাসিনো বন্ধের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ডিএমপির ডিসিদের। ডিএমপি ক্যাসিনো স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেবে। এর সঙ্গে জড়িত ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী, ক্যাডার, তাদের সহযোগিতা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর অসৎ কর্মকর্তাও। প্রতি রাতে এসব ক্যাসিনোয় কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর বসে। এতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেকেই। ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বুধবার দৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপকালে একথা স্বীকার করে বলেন, রাজধানীর ক্যাসিনো স্থায়ী বন্ধের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছি। ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেছি। ডিএমপি পুলিশ মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর বুধবার আমার তৃতীয় দিন। তৃতীয় কর্মদিবসেই জুয়ার আসর ক্যাসিনো চলছে এই ধরনের খবর আসে। রাজধানীর ৫০ থানার ৮ জোনের ডিসিকে ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুধবারই মতিঝিল ও রমনা এই দুই জোনের ক্যাসিনোর সংখ্যার তালিকা পেয়ে গেছি। মতিঝিল ও রমনা এই দুই জোনে ক্যাসিনো চালানো হয় ১৭। অপর ৬ জোনের ক্যাসিনোর সংখ্যার একটি তালিকা পেয়েছি। সব মিলিয়ে রাজধানীর ৫০ থানা এলাকার ৮ জোনে শতাধিক ক্যাসিনোর একটি তালিকা পেয়েছি। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য নেপাল, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষিত নারীদের আনা হয়েছে। বিদেশ থেকে আনা হয়েছে প্রশিক্ষিত জুয়াড়ির পাশাপাশি নিরাপত্তা প্রহরীও। ক্যাসিনোগুলোয় প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা উড়ছে। রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় রীতিমতো বাসা ভাড়া নিয়ে চলে এসব ক্যাসিনো। এর কোন কোনটিতে আবার জুয়াড়িদের মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে সুন্দরী নারীরা। ক্যাসিনোগুলোতে জুয়াড়ি ও নিজস্ব লোক ছাড়া অন্যদের ঢুকতে দেয়া হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা দৈনিক ও মাসোহারা ভিত্তিতে উৎকোচ পেয়ে থাকে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ও রাজধানীতে ক্যাসিনো চালু ছিল। নিয়ন্ত্রণ করত যুবদল। তখন ক্যাসিনো বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর এলেও তেমন কোন কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হতো না। ফলে দিনে দিনে ক্যাসিনোর সংখ্যা বেড়ে শতাধিকে পরিণত হয়েছে। এখন এই ক্যাসিনোগুলো বিএনপির যুবদলের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণ করছে যুবলীগের এক শ্রেণীর ক্যাডার। রাজধানীতে ক্যাসিনোর সংখ্যা কতÑ সে ইতোমধ্যেই তালিকা তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এই তালিকা দাখিল করা হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ মহলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দলীয় ফোরামের বৈঠকে বলেন, যুবলীগের মহানগরের (উত্তর-দক্ষিণ) বহু নেতা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনো পরিচালনা করে আসছে। তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে এসব ক্যাসিনো। এসব বন্ধ করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট পেয়ে প্রধানমন্ত্রী এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছেন যে তিনি বলেছেন, যুবলীগের সবার আমলনামা আমার হাতে। সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় যুবলীগের নেতারা অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বহুতল ভবনের ছাদ দখলে নেয়া হয়েছে। মতিঝিল ও রমনা জোনের ক্যাসিনোর যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখা যায়, কেবল সেগুনবাগিচায়ই আট স্থানে ক্যাসিনো চলে। যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের এক শীর্ষ নেতার তত্ত্বাবধানে এই ক্যাসিনো চলছে। এছাড়া মতিঝিল, ফকিরাপুল এলাকায় তিনটি ক্যাসিনো চলছে। এসব ক্যাসিনো নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগরের (দক্ষিণ) এক সাংগঠনিক সম্পাদক। এছাড়া বিভিন্ন স্পোর্টিং ক্লাব, অভিজাত এলাকার ক্লাব ও বিভিন্ন বাসাবাড়িতে রাত গভীর হলেই বসছে কোটি কোটি টাকার জুয়ার আসর। মতিঝিলের ক্লাবপাড়া ছাড়াও দিলকুশা, ব্যাংক কলোনি, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গুলিস্তান, ওসমানী উদ্যান, বঙ্গবাজার এলাকায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসে। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে অনানুষ্ঠানিক ক্যাসিনো ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগ রয়েছে গুলশান লিঙ্ক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, উত্তরা ক্লাব, নিউমার্কেট এলাকার এজাজ ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, পল্টনের জামাল টাওয়ারের ১৪ তলাসহ কয়েকটি নামীদামী রেস্তরাঁর বিরুদ্ধে। ডিএমপি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ক্যাসিনোগুলোতে ওয়ান-টেন, ওয়ান-এইট, তিন তাস, নয় তাস, কাটাকাটি, নিপুণ, চড়াচড়ি, ডায়েস, চরকি রামিসহ নানা নামে জুয়ার আসর। এসব ক্যাসিনোতে যারা আসছেন তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। আর প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্যাসিনো পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিরা। এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী। সেগুনবাগিচা-মতিঝিল-আরামবাগে খেলাধুলা চর্চার জন্য গড়ে ওঠা নামীদামী ক্লাব বাস্তবে পরিণত হয়েছে ক্যাসিনোয়। ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনো নামের জুয়ার আসর আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীর অলি-গলিতেও। ক্লাবের বাইরে বিভিন্ন এলাকার গেস্ট হাউস ও ফ্ল্যাট বাসায়ও এ ধরনের আয়োজন করা হচ্ছে। নিকেতন, নিকুঞ্জ, উত্তরা, রূপনগর, খিলগাঁও, লালবাগ, হাজারীবাগ, বাড্ডার অসংখ্য বাসায় নিয়মিত জুয়ার আসর বসানো হয়। এসব আসরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ছিনতাইকারী, ছিঁচকে চোর, পকেটমার, প্রতারক, অপরাধীরা অংশ নেয়। উত্তরার একটি অভিজাত ক্লাবে নেপালীসহ কয়েক বিদেশী নারী-পুরুষের সহযোগিতায় চালানো হচ্ছে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্য। উত্তরার পাশাপাশি দক্ষিণখানে, আশকোনাতেও রয়েছে ক্যাসিনো। জুয়ার আসরগুলো থেকে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, মাস্তান, কমিউনিটি পুলিশের ইউনিট, ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পিএস-এপিএসদের দৈনিক বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোককে ম্যানেজ করেই দিনের পর দিন চলছে এসব কর্মকা- চালানোর ঘটনা অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’। ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশের পর বুধবার থেকেই খুদে বার্তার মাধ্যমে ক্যাসিনোয় আগত জুয়াড়িদের আসতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। অনেক ক্যাসিনো বন্ধ হয়ে গেছে। সাদা পোশাকে ক্যাসিনোগুলোর তালিকা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে অভিযান পরিচালনায় অংশ নিচ্ছে পুলিশ। সেবার মান বাড়াতে থানায় থাকার নির্দেশ ॥ সেবার মান বাড়াতে উপকমিশনারদের সপ্তাহে দুই থেকে তিন ঘণ্টা থানায় উপস্থিত থাকার নির্দেশ জারি করেছেন ডিএমপি কমিশনার মোহাঃ শফিকুল ইসলাম। মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনারের তরফ থেকে অপরাধ বিভাগের সকল উপকমিশনার বরাবর পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট উপকমিশনাররা তাদের আওতাভুক্ত প্রত্যেক থানায় প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন ঘণ্টা অবস্থান করবেন। থানার বাস্তব কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করবেন। সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে সরাসরি আইন অনুযায়ী সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ বা যেকোনও ধরনের তথ্য সঠিকভাবে আমলে নিয়ে যথাযথ পুলিশী বা আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধিসহ সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রায়ই নিরীহ, অসহায় জনসাধারণের একটা বিরাট অংশ থানায় গিয়ে প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হন বলে অভিযোগ আছে। আমলযোগ্য অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ আমলে না নেয়া এবং অনাকাক্সিক্ষত কালক্ষেপণ করা হয়। ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণসহ অনেক সময় অযথা হয়রানিমূলক আচরণের মাধ্যমে তাদের প্রাপ্য আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। থানায় সেবার মান বৃদ্ধি ও সেবাপ্রত্যাশীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যাপারে ওসি কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন। থানার কার্যক্রম সর্বক্ষণিক মনিটরিং করবেন সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও এডিসিরা। গত ১৫ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির কমিশনার জানান সেবার মান উন্নয়নের কথা। ডিএমপির অধীনে কোন থানায় যদি জনগণ কাক্সিক্ষত সেবা ও ভাল আচরণ না পান তাহলে সিনিয়র অফিসারদের থানায় বসানো হবে।
×