ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৪ আষাঢ় ১৪৩১

স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

​​​​​​​আহমেদ শাওন

প্রকাশিত: ২২:১০, ২৪ মে ২০২৪

স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

.

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে জল্পনা-কল্পনার যেন শেষ নেই। আগামী দিনে কি মানুষের জায়গা দখল করে নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে মানুষের অস্তিত্বের জন্যই কি কোনো হুমকি তৈরি করছে এআই! রকম নানা কৌতূহল আর নতুন নতুন জিজ্ঞাসারই জবাব আসছে এবার। জানা যাচ্ছে এআইর অপরিমেয় সম্ভাবনা নিয়ে, সেই সঙ্গে তার সীমাবদ্ধতা নিয়েও। পৃথিবীজুড়ে মানুষের কর্মপ্রবাহে আসছে গতিশীলতা, আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রযুক্তি প্রথমে আসে ভয়ের কারণ হয়ে; কারণ শুরুতেই তার সম্ভাবনার দিকগুলো মানুষের সামনে স্পষ্ট হয়। ফলে দেখা যায়, যে কাজ মানুষের করতে অনেক সময় এবং শ্রমের প্রয়োজন হতো, অনেক অর্থের ক্ষতি স্বীকার করতে হতোÑ তা হয়ে যাচ্ছে অনেক সহজেই। এবার রকমই হচ্ছে এআইর ক্ষেত্রেও। বিবিধ বিষয়ে অল্পবিস্তর ভূমিকা রাখলেও এবার স্বাস্থ্যসেবায় ভালোই ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে এআই।

২০১৯ থেকে ২০২১। সময়ে স্বাস্থ্যসেবার কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার গবেষণা এবং উপদেষ্টা কোম্পানি গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের এক বিশ্লেষণে কথা বলা হয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রোগ নির্ণয় চিকিৎসার ক্ষেত্রকে নির্ভুলতম করবে। কমিয়ে আনবে রোগ নির্ণয়ের সময়কে। পাশাপাশি চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ককে করবে উন্নত। রোগবিজ্ঞান বা প্যাথলজির প্রতিবেদন থেকে ক্যান্সার খুঁজে বের করতে এআই সময় নেয় এক সেকেন্ডের চার ভাগের এক ভাগ সময়। শুনে কী মনে হলো? না, তেমন অগ্রগতি হয়নি। আচ্ছা, তাহলে মানুষের সঙ্গে তুলনা হয়ে যাক। গড়ে একজন বিশেষজ্ঞ মানুষের প্রতিবেদন ঘেঁটে ক্যান্সার শনাক্ত করতে লাগতে পারে ৯০ সেকেন্ড থেকে তিন মিনিট। এবার হিসাবটা আরেকটু বিস্তৃতভাবে দেখা যাক। হ্যাঁ, তিন মাসে এই প্রযুক্তি মানুষের কাজের সময় বাঁচিয়েছে ১১,১৪১ ঘণ্টা। কর্মঘণ্টা ধরে হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৩৯২ দিন। ক্যান্সার বিষয়ক সাময়িকী জার্নাল অব অনকোলজিতে প্রকাশিত হিসাবে আরও বলা হয়েছে, এতে রোগীরা চিকিৎসা পেয়েছেন সাত দিন আগে। এআই কীভাবে চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছে, এটি তারই একটা মাত্র উদাহরণ। ভবিষ্যতে এটি আরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে নিয়ে আসবে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জও।

ভেতরে রয়েছে যে মস্তিষ্ক : প্রথমে কারও কারও কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেকেই আইফোনের সিরি, রোবটচালিত ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করেছেন। কিংবা আলেক্সাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। মানে দাঁড়াল, এইআইয়ের সঙ্গে এরই মধ্যে আপনার প্রাথমিক মোলাকাত হয়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, সত্যিকার অর্থে এআই বলতে কী বোঝানো হয়? কেউ কেউ অতি প্রচলিত মজাও এখানে করতে পারেন। এআই কী খায় না মাথায় দেয়! পাঠ্য বইয়ে দেওয়া সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মানুষের ঠিক করে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা যে বুদ্ধিমত্তা অর্জন করতে পারে, তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। অ্যানোসেন্স নামে জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও লুরং প্যান পিএইচডি কথা বলেন। এআই-চালিত ওষুধের নকশা খাটিয়ে নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে অ্যানোসেন্স। তিনি আরও বলেন, একটি বিশেষজ্ঞ ব্যবস্থা হিসেবে কমপক্ষে এআইকে নির্দিষ্ট পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের স্থলাভিষিক্ত হতে হবে। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদের যেসব উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করার সক্ষমতা নেই, তা অর্জন করবে অত্যাধুনিক এআই।

এমন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে এইআই প্রযুক্তিকে শিক্ষণের পর্যায় পাড়ি দিতে হয়। এটি মানুষের শিক্ষণ প্রক্রিয়ারই অন্য রূপ। একো নামের সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা কনোর ল্যান্ডগ্রাফ বলেন, ব্যাখ্যা এবং বারবার একই কাজ করতে করতে শিক্ষা লাভ করে শিশুরা।

একইভাবে শিক্ষণ পর্ব পার হতে হয় কম্পিউটারকেও। এআই চালিত প্রথম স্টেথোস্কোপ বানিয়েছে একো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এআই যন্ত্রকে একোর পক্ষ থেকে হাজার হাজার হৃৎপিন্ডে শব্দ শোনানো হয়েছে। হৃদরোগ থাকলে হৃৎপিন্ডে শব্দে যে ধ্বনি শোনা যায় বা হৃৎপিন্ডে যে শব্দধ্বনি, তা থেকে স্বাভাবিক ধ্বনি আলাদা করতে হয়েছে যন্ত্রকে। বারবার একই কাজ করার মধ্য দিয়ে কম্পিউটারের অ্যালগরিদম নিজে নিজেই এবারে হৃৎপিন্ডে শব্দধ্বনি আলাদা করার মতো দক্ষতা অর্জন করেছে। (কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় কোনো সমস্যা সমাধান বা কাজ সম্পাদনের জন্য যে একগুচ্ছ নির্দেশ দেওয়া হয়, তাকেই অ্যালগরিদম বলা হয়।) এখন এআই স্টোথো মাত্র ১৫ সেকেন্ডেই হৃদরোগ ধরতে পারে। তিনি আরও বলেন, এআই দ্রুত সময়ের মধ্যেই কাজটি করছে, তা কেবল নয়। বরং মানুষের চেয়ে নির্ভুলভাবেই করছে নিজ কাজ। এআই-চালিত এই স্টোথো সারা দুনিয়ার হাজার হাজার চিকিৎসক ব্যবহার করছেন। কম সম্পদশালী দেশগুলোতেও এর ব্যবহার চলছে। সেখানে দিনে দুই হাজার রোগী দেখার কাজ করতে পারছে চৌকস যন্ত্র (প্রসঙ্গত, যতটুকু খোঁজ নিয়েছি জানতে পেরেছি যে বাংলাদেশে এখনো এর ব্যবহার শুরু হয়নি)

এআইয়ের মানুষের মতো চিন্তা করার এবং শেখার ক্ষমতায় প্যান অবাক নন। তিনি বিস্মিত হন এর নতুন জিনিস কল্পনা করার ব্যাপক সক্ষমতা দেখে। গবেষক নারী বলেন, এআইয়ের কল্পশক্তির ব্যাপকতা মানুষের চেয়েও অনেক অনেক বেশি। বিজ্ঞানী বিশেষ করে ওষুধ বিজ্ঞানীরা ছোট এবং সহজে গ্রহণযোগ্য নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করছেন।

ব্যবহারে ইতিবাচক ফল : গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা শিল্প এআইকে খাটাচ্ছে। ওষুধ আবিষ্কারের কাজে আরও আগে থেকেই এআইকে লাগানো হচ্ছে। পর্দার আড়ালে এআই ব্যবহারের বিষয়টি গরপড়তা রোগী বা ভোক্তা বা সাধারণ পর্যায়ের মানুষজন তেমন কিছুই জানেন না। কথাটি বলেন আজরা এআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ক্রিস ক্যাশওয়েল। তার প্রযুক্তি আমেরিকার দুই হাসপাতাল ব্যবহার করছে। এআইয়ের প্রয়োগক্ষেত্র সুবিশাল হতে পারে।

ভবিষ্যতের সোনালি সময় : স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধ উদ্ভাবন বিকাশের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাবের ডানা বিস্তার করেছে এআই। বিশেষজ্ঞরা জানান, এআইয়ের ভবিষ্যৎ আরও প্রতিশ্রুতিশীল। প্যানের ধারণা, মোটামুটি ১০ হাজার রোগবালাইয়ের বেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এআই। এর মধ্যে আট হাজারই হলো জেনেটিক বিরল অসুখ-বিসুখ। আজও এসব রোগের কোনো চিকিৎসা বের করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও বলেন, এআইয়ের সহায়তায় এসব অসুখ-বিসুখ দ্রুত এবং সহজে নির্ণয় করা যাবে। এতে চিকিৎসাও সম্ভব হবে। আশা করা হচ্ছে, ধরনের প্রতি রোগের ওষুধ উদ্ভাবন করার সময় এবং খরচ উভয়ই ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ বাঁচবে। আর চিকিৎসার খরচ নেমে আসবে সহনীয় স্তরে।

বর্তমানে এমন রোগীদের নিয়মিত পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকের কাছে ছুটতে হয়। ভবিষ্যতে তারা ঘরে বসেই এআই-চালিত যন্ত্রপাতি দিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে পারবেন। এগুলো তাদের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ এবং অক্সিজেনের মাত্রার মতো বিষয়গুলো পরিমাপ করতে পারবে।  তবে এইআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই- পাশাপাশি কথা ভাবাও ঠিক হবে না। প্যান জানান, এর মধ্যে অন্যতম হলো, এআইকে প্রধানত উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। উপাত্তের মানের ওপর এআইয়ের সক্ষমতা নির্ভর করে। অন্যভাবে বলা যায়, উপাত্ত খারাপ দিলে ফলাফলও খারাপ হবে। ছাড়া এআই এমন এক প্রযুক্তি, যা সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না। বা আস্থাও রাখা যায় না। কারণে অনেকেই উদ্বেগে পড়েছেন। প্যান বলেন, এআই হলো জ্ঞানের কৃষ্ণবাক্স। প্রচলিত রসায়ন বা জীববিজ্ঞানের নিয়মকানুন দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। ফলে বিশেষজ্ঞরা সহজে এর ওপর আস্থাও রাখতে চান না বলে প্যান জানান। এআইয়ের সম্ভাবনা অনেক প্রতিশ্রুতির জন্ম দিয়েছে; তবে প্রকৃত অর্থে এআইয়ের তৎপরতা মাত্র শুরু হয়েছে।

×