ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানে ফেরা

ড. শাহজাহান মণ্ডল

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ৭ নভেম্বর ২০২৩

ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ’৭২-এর সংবিধানে ফেরা

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে

পার্লামেন্ট জনগণের প্রতিনিধি, আর সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। রাষ্ট্রপতি ও স্পিকার অভিশংসনের বা অপসারণের ক্ষমতা যেমন পার্লামেন্টের হাতে রয়েছে তেমনি বিচারক অপসারণ ক্ষমতা পার্লমেন্টের হাতে রেখে দেওয়া হলে জনগণের প্রতিশ্রুতি, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ’৭২-এর সংবিধানে ফেরাটা অনেকাংশেই পূরণ হয় বৈকি

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারককে অপসারণ করার বিধান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত। অসদাচরণ বা অসামর্থ্য প্রমাণিত (proved misbehavior or incapacity) হলে তাকে অপসারণ করার ক্ষমতা এখন পার্লামেন্টের হাতে। ৩৫০ এমপির মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে (বা ২১৭ ভোটে) এ অপসারণ সম্ভব। এ নিয়ম করা হয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এ নিয়ম ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারতের মতো, পাকিস্তানের মতো নয়। ইংল্যান্ডে নিয়মটি ১৭০১ সালের Act of Settlement নামক আইনে সৃজিত হয়, এখন আছে ১৯৮১ সালের Supreme Court Act-এর  ১১(৩) ধারায়। আমেরিকার পার্লামেন্ট রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন (ইমপিচ) করার মতো সুপ্রিম কোর্টের বিচারককে সরাতে পারে।

ভারতে ১৯৬৮ সালের ঔঁফমবং ওহয়ঁরৎুঅপঃ মোতাবেক পার্লামেন্ট এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও চিন্তাপ্রসূত বাহাত্তরের (১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর) সংবিধানে এ বিধান ছিল। তখন ছিল এখনকার মতো পার্লামেন্টারি বা মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার। পরে যেদিন ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হয় সেদিন এ ক্ষমতা আসে রাষ্ট্রপতির হাতে। এরপর পঁচাত্তরেরর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার প্ল্যানমাস্টার জিয়াউর রহমান বন্দুকের জোরে সেনাবাহিনীর উর্দি পরে সামরিক ফরমান দিয়ে এ নিয়মের পরিবর্তন ঘটান এবং ১৯৭৬ সালের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের মতো তিন বিচারকের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’-এর হাতে এ ক্ষমতা প্রদান করেন। দীর্ঘ ৩৮ বছর পর ২০১৪ সালের  ১৭ সেপ্টেম্বর ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এ অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে পুনরায় ফিরে আসে।
এতে নাখোশ হন পাকিমুখী কতিপয় বিখ্যাত আইনজীবী, যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তথা আওয়ামী লীগ থেকে জীবনের বহু পদ-পুরস্কার পেলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সেনাশক্তির সরকার কর্তৃক অন্যায়ভাবে ও ভিত্তিহীনভাবে গ্রেপ্তার হন তখন তার জামিনের জন্য আইনি লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানান। এ আইনজীবীগণ ষোড়শ সংশোধনীর বিরুদ্ধে রিট করেন হাইকোর্ট বিভাগে। হাইকোর্ট বিভাগের কতিপয় বিচারক ষোড়শ সংশোধনী বাতিল মর্মে রায় দেন। তাতে পাকমুখী আইনজীবীগণ ভীষণ খুশি হন। তখন রাষ্ট্রপক্ষ তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মাধ্যমে আপিল বিভাগে আপিল করে।

কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারকের বেঞ্চ ওই রায় বহাল রাখেন। এ রায়ের পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। তারই শুনানি আগামী ৯ নভেম্বর ২০২৩। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ রিভিউ আবেদন শুনবেন এবং চূড়ান্ত রায় দেবেন। এক্ষণে ওই বেঞ্চের নিকট বিবেচনার জন্য নিচের কয়েকটি যুক্তি তুলে ধরে অনুরোধ জানাব, রায় বাতিল করে ষোড়শ সংশোধনী যেন বহাল রাখা হয়, পাকিস্তানের মতো ব্যবস্থা চালু না হয়।
(র) আইনের ছাত্র হিসেবে খট্কা লাগে, নিজেদের অপসারণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ কি মামলা গ্রহণ করতে পারেন বা বিচার করতে বা রায় দিতে পারেন? ব্যাপারটা নিজের বিচার নিজে করার মতো হয়ে গেল না কি? Principle of Natural Justice তথা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচার নীতি তো বলে, কেউ নিজের বিষয়ে বিচারক হতে পারেন না। সে সময় এ নিয়ে প্রধান বিচারপতি ও প্রধান আইন কর্মকর্তার (অ্যাটর্নি জেনারেল) মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। গালাগালি হয় বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশ। অ্যাটর্নি জেনারেল এমনও বলেন যে, জীবনের জঘন্যতম গালি তিনি শুনলেন এবং এর রক্তক্ষরণ হতেই থাকবে। সাধারণ জনগণ এটি মোটেই পছন্দ করে না।

তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা প্রথমে আপিল বিভাগের সাতজনের মধ্য থেকে পাঁচজন বিচারপতি নিয়ে শুনানি করতে চেয়েছিলেন, দুজনকে বাদ রাখতে চেয়েছিলেন। পরে অ্যাটর্নি জেনারেলের জোর দাবির প্রেক্ষিতে বাকি দুজনকে যুক্ত করে শুনানি শুরু করেন। অনুমান করা অসঙ্গত নয় যে, এই পাঁচ এবং সাত সংখ্যার মধ্যে কোনো সাত-পাঁচ ছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এমনও বলেন, সরকার পক্ষে ১০০ জন বললেও তা আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না-ও হতে পারে।

এগুলো থেকে এ অনুমান হওয়া অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, এটি নিয়ে আদালত পূর্বমনস্থ (প্রি-ডিটারমাইন্ড) হয়ে পড়েন। আর যদি তা-ই হয় যে, সরকার পক্ষে (অ্যাটর্নি জেনারেল ও এডিশনাল অ্যাটর্নি জনারেলসহ) ১০০ জন যুক্তি উপস্থাপন করলেও কথা শোনা হবে না তাহলে মামলার মেরিট কি থাকল? বস্তুত ওই পূর্বমনস্থরই বহির্প্রকাশ রায়ের মধ্যে দেখা যায়। এখন পর্যন্ত যে রায় রয়েছে তা Principle of Natural Justice তথা প্রাকৃতিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি এবং biassed।
(ii) যদি ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায় তাহলে সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আনা পাকিস্তানি ধরনের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে আবার এ ক্ষমতা চলে যাবে, যা হবে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি প্রখ্যাত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিয়মের পরিপন্থি এবং পাকিস্তানপন্থি এক ব্যবস্থা। বাংলাদেশকে এটি পিছিয়ে দেবে, পাকিপন্থিদের উস্কে দেবে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। রিটকারী আইনজীবীগণ দাবি করেন যে, পার্লামেন্টের হাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা গেলে তা হবে অবৈধ ও অসাংবিধানিক। কিন্তু তা কি করে হয়? সেনাশাসক জিয়ার সামরিক ফরমান দ্বারা প্রবর্তিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথে স্বয়ং পার্লামেন্ট বিচারক অপসারণের অধিকারী হলে তা কি করে অবৈধ ও অসাংবিধানিক হয়?

গণতন্ত্র ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার রক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেন কে? বঙ্গবন্ধু, নাকি কোনো সেনা অফিসার? যতক্ষণ পার্লামেন্টারি বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার থাকে ততক্ষণ বিচারক অপসারণ ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে থাকাটা পার্লামেন্টারি ধরনের সরকারের সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ এ ব্যবস্থায় এমপিগণ প্রেসিডেন্টের বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকেন না। বরং তাদের নিকট মন্ত্রীগণ জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন। অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে এ ক্ষমতা যাওয়াটা পার্লামেন্টারি ধরনের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ মাত্র ৩ সদস্যের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের থেকে ৩৫০ এমপির পার্লামেন্ট কি বৃহৎ পরিসর নয়? সুতরাং হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে যে রায় দিয়ে রেখেছেন তা এখতিয়ারবহির্ভূত। এ রায় নিজেই অসাংবিধানিক, নিজেই অবৈধ।
(ররর) পার্লামেন্ট বিচারক অপসারণের ক্ষমতা প্রয়োগ করলে কি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়? মোটেই না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে কি শুধু অপসারণের ব্যাপারটি বোঝায়? আর কিছু বোঝায় না? বিচারককে প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়নে যখন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ পেতে হয়, তখন কোনোক্রমেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। প্রধানমন্ত্রীসহ পার্লামেন্টের সদস্যরা যখন বিচারকের বেতন নির্ধারণ করেন তখনো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। আসল কথা কি, বিচার করার ক্ষেত্রে বিচারকগণ পার্লামেন্ট কর্তৃক চাপে না পড়লেই হলো। বিচারকগণ অন্যায় প্রলোভনে প্রলুব্ধ না হয়ে বিচার করতে পারলেই হলো। বিচার বিভাগের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা বিচারকগণের নিজের কাছে। তারা নিজেরা তা চর্চা করলে কারও ক্ষমতা নেই তা থেকে বিরত রাখার।
(রা) আজকে এই মুহূর্তে যদি কোনো বিচারককে অপসারণ করার প্রশ্ন ওঠে তাহলে তা পার্লামেন্টের মাধ্যমেই হবে। কারণ সংবিধান এখনো পার্লামেন্টের হাতে এ ক্ষমতা রেখেছে। রায় তার কোনো ক্ষতি করেনি। মামলা এখনো চলমান। সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান সর্বোচ্চ আইন, সুপ্রিম কোর্টের রায় সর্বোচ্চ আইন নয়। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যে কোনো আইন বাতিল গণ্য হয়। কাজেই সুপ্রিম কোর্টের রায় এই মুহূর্তে অকার্যকর গণ্য হবে, সংবিধান প্রাধান্য পাবে।
(া) বিচার বিভাগ মনে রাখলে ভালো যে, জনগণকে মহাজোটের দেওয়া অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি হলো বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়া। সরকারের তিন বিভাগের একটি হিসেবে বিচার বিভাগেরও প্রতিশ্রুতি এটি। প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করে তা পূরণ করার বিষয়ে বিচার বিভাগের কর্তব্য রয়েছে বৈকি।
জনগণের নির্বাচিত পার্লামেন্টকে অবিশ্বাস করার যুক্তি নেই। যেমনভাবে আমরা জনগণ অবিশ্বাস করিনি ’৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচিত পার্লামেন্ট বা গণপরিষদকে, যার ওপর জনগণের আস্থা ও পরম নির্ভরতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এনে দিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। ওই পার্লামেন্ট বা গণপরিষদই বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করে। ’৭২-এর সংবিধান মূলত সেই চেতনা ধারণ করে যার ভিত্তিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং ৩০ লাখ জীবন আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ’৭১-এর স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

তাই জনগণ প্রত্যাশা করে, আপিল বিভাগ জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি সংবিধানের সঠিক প্রয়োগ করবেন, রায়টি রিভিউপূর্বক বাতিল করবেন, ষোড়শ সংশোধনী বহাল রাখবেন এবং বিচারক অপসারণ ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে রাখবেন। পার্লামেন্ট জনগণের প্রতিনিধি, আর সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারকে অভিশংসনের বা অপসারণের ক্ষমতা যেমন পার্লামেন্টের হাতে রয়েছে তেমনি বিচারক অপসারণ ক্ষমতা পার্লমেন্টের হাতে রেখে দেওয়া হলে জনগণের প্রতিশ্রুতি, বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ’৭২-এর সংবিধানে ফেরাটা অনেকাংশেই পূরণ হয় বৈকি। এটি জাতীয় স্বার্থেও জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক, সাবেক ডিন, আইন অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া এবং কেন্দ্রীয় আইন বিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ

×