ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

বঙ্গবাজার মার্কেট নির্মাণকাজ উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

অস্ত্র চোরাচালানের রুট বন্ধ করেছি

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৫ মে ২০২৪

অস্ত্র চোরাচালানের রুট বন্ধ করেছি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার বঙ্গবাজার প্রাঙ্গণে চার প্রকল্পের নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন

আওয়ামী লীগ সরকারে এসে ভারতে সেভেন সিস্টারে শান্তি প্রতিষ্ঠায় উলফাসহ বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের কাছে বাংলাদেশ থেকে অস্ত্র চোরাচালানের রুট বন্ধ করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকার এসে এই বাংলাদেশে অস্ত্র চোরাকারবারির যে রুট সেটা আমরা বন্ধ করেছি।

ভারতে উলফা থেকে শুরু করে যেখানে যেখানে যারা অস্ত্র সাপ্লাই (সরবরাহ) দিত, সেগুলো আমরা বন্ধ  করেছি, তাদেরও যাতে শান্তি আসে। তাদের ওই সেভেন সিস্টারে (শান্তি আসে) সেই ব্যবস্থাটা কিন্তু আওয়ামী লীগ করেছে; এটা সব থেকে বড় কাজ।

শনিবার রাজধানীর বঙ্গবাজারে ১০তলা বঙ্গবাজার পাইকারি মার্কেটসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যে ল্যান্ড বাউন্ডারি (ছিটমহল) সেটাও বিনিময় করে সারাবিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। বিশাল সমুদ্রসীমা আমরা জয় করেছি। যারা আগে ক্ষমতায় ছিল তারা (বিএনপি) তো ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। জানতই না।

বিএনপি সরকারের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা ক্ষমতায় এসেছিল লুটপাট করতে, দুর্নীতি করতে, অস্ত্র চোরাকারবারি করতে, সে কাজেই ব্যস্ত ছিল, আর মানুষ খুন করতে। এই দেশটাকে তারা কোথায় নিয়ে গিয়েছিল, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অস্ত্র চোরাকারবারি; ওই তারেক জিয়া তো অস্ত্র চোরাকারবারির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ওখানে বসে (লন্ডন) এখন নানাভাবে ওই অগ্নিসন্ত্রাস দিয়ে মানুষ মারা, মানুষ খুন করা, আগুন দিয়ে মানুষকে পোড়ানো- এসব কাজ করে বেড়ায়। টানা গত তিন মেয়াদে তার সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রেখে এগিয়ে যেতে হবে, সেভাবেই আমরা এগিয়ে যাব।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিএসসিসির অধীনে চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে বলেন, ঢাকাবাসী যাতে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে, সেজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। চারটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই এলাকার (ঢাকা বিশেষ করে পুরান ঢাকার) মানুষ উপকৃত হবে এবং তারা সুন্দর জীবনযাপন করতে পারবে। এই প্রকল্পগুলো নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে।

প্রকল্পগুলো হচ্ছে বঙ্গবাজারেবঙ্গবাজার নগর পাইকারি বিপণি বিতান’, পোস্তগোলা ব্রিজ থেকে রায়েরবাজার স্লুইসগেট পর্যন্ত আট সারিরবীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক মণি সরণি (ইনার সার্কুলার রিং রোড)’, ধানমন্ডি হ্রদেনজরুল সরোবরএবং শাহবাগেহোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শিশু উদ্যানআধুনিকীকরণ শীর্ষক চারটি উন্নয়ন প্রকল্প।

অনুষ্ঠানে ডিএসসিসির আওতাধীন উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা- আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন নাছিম এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইব্রাহিম।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্ধিত ঢাকার জনগণ যেন যথাযথ সেবা পেতে পারে, সেজন্য নগরীকে তিনি উত্তর দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এই দুটি অংশে ভাগ করেন। যেগুলো ইউনিয়ন ছিল সেগুলোকেও সিটি করপোরেশনের আওতায় নিয়ে এসে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঠিকানাবিহীন পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসন সমস্যা দূর করতে সরকার আবাসিক ফ্ল্যাট সম্মানজনক পদবির ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ঢাকা শহরের পূর্ব-পশ্চিমে রাস্তাই ছিল না। তার সরকার সেসব রাস্তা, ওভারপাস, মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, বাঁধের ওপর রাস্তা (বুড়িগঙ্গা বেড়িবাঁধ) করে দিয়েছে এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে যেগুলোর বাস্তবায়ন হয়ে গেলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। আন্তঃজেলা যোগাযোগ সহজ করতে ঢাকায় একটি রিং রোড নির্মাণ করতে চাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এখান থেকে সরিয়ে কেরানীগঞ্জ নেওয়া হয়েছে। পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে যেখানে জাতির পিতা দীর্ঘদিন বিভিন্ন সময় বন্দি ছিলেন, যেখানে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং ফাঁসির মঞ্চ যেখানে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর হাজার হাজার সেনাবাহিনীর অফিসার, সৈনিক, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি দিয়েছিল আর ব্রিটিশ আমল থেকেই অনেক দেশপ্রেমিককে সেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়। সেই জায়গাটিসহ সকল স্থানের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এর বাইরে স্কুল এবং পার্ক করে সৌন্দর্যবর্ধন এবং বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঠিক এইভাবেই এই এলাকার মানুষ যাতে ভালোভাবে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করেছি।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবাজার পুনর্নির্মাণে ব্যবসা চালু রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বলেন, এর আগে তিনি মোবাইল লেনদেনের মাধ্যমে অগ্নিকা- ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের অনুদান দিয়েছিলেন। পুরান ঢাকার সঙ্গে তাঁর একটা আলাদা নাড়ির টান রয়েছে। কাজেই এই অঞ্চলের মানুষেরা ভালো থাকুক, সেটাই তার লক্ষ্য।

স্মৃতি রোমন্থনে টানা চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হন, তাঁর পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকায় এসে প্রথমেই তাঁরা / রজনীবোস লেনের একটি বাড়িতে ওঠেন। এরপর বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী হলে মিন্টো রোডে চলে আসেন।৯২-এরধারায় জরুরি আইন জারি করা হলে ১৪ দিনের নোটিসে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হন। ৭৯ নম্বর নাজিরা বাজারে অবিভক্ত ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ফুপুর বাড়িতে তারা দীর্ঘদিন ছিলেন। মাঝে বন্যা হলে আরমানীটোলার বাঘওয়ালা বাড়িতেও (স্থানীয়রা বলত) ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার জন্ম ঢাকার মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আর ছোট ভাই শেখ রাসেলের জন্ম ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে।

সরকারপ্রধান বলেন, মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের শুরুটা যেন চানখারপুল থেকে হতে পারে সরকারে আসার পর তিনিই সেটার ব্যবস্থা করেছেন। তা ছাড়া আজকে যে প্রকল্পগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলো সেগুলো বাস্তবায়ন হলেও এলাকার মানুষই লাভবান হবে।

প্রধানমন্ত্রী জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় সম্পর্কে বলেন, এটি একটি প্রাইমারি স্কুল ছিল পরে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল এবং  সেখান থেকে কলেজ হয়। আর এখন বিশ^বিদ্যালয়। এতটুকু জায়গা, বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো হোস্টেল। তাঁর সরকার এগুলো সব একত্রিত করে একটি ভালো ক্যাম্পাস এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত করে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকদের আবাসস্থল নির্মাণ করে শিক্ষার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে জায়গা ডিজাইন করা হয়ে গেছে, সে কাজও শীঘ্রই শুরু হবে। সেভাবে নতুন ক্যাম্পাস আমরা করে দেব যাতে করে একটা সুস্থ পরিবেশে ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে।

শেখ হাসিনা বলেন, ইতোমধ্যে তাঁর সরকার ঢাকার মানুষের যোগাযোগ স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকেও বিশেষ নজর দিয়েছে। এক সময় বিদ্যুৎ থাকত না, পানি থাকত না। আপনাদের মনে আছে সেই বিদ্যুৎ পানির দাবিতে মানুষের আন্দোলনে বিএনপির এক নেতা (স্থানীয় এমপি) জনগণের ধাওয়াও খেয়েছিল। কিন্তু তাঁর সরকার ঢাকাবাসীর জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন করেছে। সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের উন্নয়ন ঘটিয়েছে এবং মানুষের বিদ্যুতের ব্যবহারও বেড়েছে। তিনি সময় নিজ নিজ পানির ট্যাঙ্ক নিয়মিত পরিষ্কার রাখাসহ বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য পানি জমে থাকা জায়গা পরিচ্ছন্ন রাখা এবং পানি বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়ী হবার পরামর্শ দেন।

প্রধানমন্ত্রী সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতেও সবার সহযোগিতা চান। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার এবং সিটি করপোরেশনকেও তিনি দ্রুত এগুলো সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। সময় তিনি আসন্ন কোরবানির ঈদে যেখানে-সেখানে পশু কোরবানি না দেওয়ার জন্যও নগরবাসীকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ভবিষ্যতে শুধু সিটি করপোরেশন নয়, সমগ্র বাংলাদেশেই তাঁর নির্দেশ রয়েছে প্রত্যেক জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ব্যবস্থা গড়ে তোলার।

তাঁর সরকার ঢাকা শহরের জলাধারগুলো উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে যত্রতত্র পুকুর-খাল, জলাশয় ভরাট করে স্থাপনা তৈরি না করার জন্য নগর পরিকল্পনাবিদদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অতীতের সরকারগুলো পুকুর, খাল ভরাট করে স্থাপনা বা বক্স কালভার্ট নির্মাণ করায় খাল-বিল-পুকুরে ভরা ঢাকা শহরের বাতাসও এখন ভারী হয়ে উঠেছে, পানি সরার কোনো জায়গা থাকছে না। তিনি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং মাদক থেকে সকলকে দূরে থাকার এবং সিটি করপোরেশনের পার্কগুলো যেন মাদক সেবনে ব্যবহার না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

×