ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১

বরফের মাঝে আটকে আছে ইঁদুর, শরবতের নামে রাস্তায় কী খাচ্ছি আমরা?

প্রকাশিত: ১৭:০৫, ২৮ এপ্রিল ২০২৪; আপডেট: ১৭:৩৬, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

বরফের মাঝে আটকে আছে ইঁদুর, শরবতের নামে রাস্তায় কী খাচ্ছি আমরা?

নানা রংয়ের পানীয়তে তৃষ্ণা মিটলেও স্বাস্থ্যের জন্য তা অনিরাপদ

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ছবি তীব্র আকারে ভাইরাল হয়েছে। যে ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে বরফের মাঝে আটকে আছে একটি ইঁদুর। ছবিটি শেয়ার করে কথাকলি ঘোষ নামের একজন ব্যবহারকারী লিখেন,  সমস্যা কি?  ইঁদুর তো গ্লাস পর্যন্ত আসবেনা।  শরবত প্রেমীরা একটু সাবধানে খাবেন!

এছাড়াও আশিক গওহর নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেন, রাস্তাঘাটের শরবতে এমন বরফ ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা আপনি কি নিশ্চিত?? 

যদিও ছবিটি কোন স্থানের এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এই ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পরপরই মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে এই গরমে শরবতের নামে যা খাচ্ছি আমরা তা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত। 

একদিকে নগরীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। উত্তপ্ত হচ্ছে চারপাশ। অন্যদিকে ব্যস্ত নগরীতে রোদে পুড়ে একটু শীতলতা খুঁজে বেরাচ্ছে  নগরবাসী। তীব্র গরমে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠা শ্রমজীবীরা প্রাণ জুড়াতে হাতে তুলে নিচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের পানীয়। 

স্বচ্ছল মানুষেরা বিভিন্ন জুসবার বা ডাবের পানিতে তৃষ্ণা মেটালেও স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা রাস্তার পাশের রকমারি শরবতের দোকানগুলো। এসব দোকান থেকে নানা রকম ঠান্ডা পানীয় পান করে তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন তারা।

তৃষ্ণা মেটালেও প্রশ্ন থেকে যায়, পথের ধারের এসব পানীয় কতটা নিরাপদ? কী ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন নগরীর স্বল্প আয়ের এই মানুষগুলো যারা জেনে বা না জেনে কিংবা সাধ্য অনুযায়ী রাস্তার পাশের  এসব পানীয়গুলো পান করছেন?

রাজধানীর বাংলামটর, মিরপুর স্টেডিয়াম এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার পাশে বিভিন্ন রং-বেরঙের ও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের শরবত বিক্রি হচ্ছে পুরোদমে। তাপমাত্রা যত বাড়ছে ততোই বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই পান করছে রাস্তার পাশের শরবত।

এসব দোকানে লেবুর শরবত প্রতি গ্লাস ১০ টাকা, প্যাকেটজাত ফ্লেভার দিয়ে বানানো ৫০০ মিলি লিটার বোতলের শরবত ২০ টাকা, বেলের শরবত প্রতি গ্লাস ২০ টাকা ও তোকমাসহ বিভিন্ন ফল দিয়ে বানানো শরবত প্রতি গ্লাস ২০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।

উন্মুক্ত স্থানে, ধুলায় আচ্ছন্ন রাস্তায় নোংরা পরিবেশে উন্মুক্তভাবে বিভিন্ন ফল সাজিয়ে রাখা হয়। এগুলো দিয়েই তৈরি হয় ফলের শরবত। সাজিয়ে রাখা খোলা বেলে ধুলোময়লা যাচ্ছে, সেটা দিয়ে শরবত বানান কেন? জানতে চাইলে এক বিক্রেতা বলেন, এগুলো স্যাম্পল। এগুলো দিয়ে শরবত বানাই না। কিছুক্ষণ পরে তাকে ওই বেল দিয়েই শরবত বানাতে দেখা যায়। আবার প্রশ্ন করলে তিনি কোনও উত্তর দেননি।

রাস্তার পাশে সিএনজি অটোরিকশা থামিয়ে শরবত পান করছিলেন চালক কেরামত আলি। তিনি জানান সারাদিন রোদের মধ্যে ঘুরতে হয়। আর গাড়ির মধ্যে এমনিতেই গরম হয়ে থাকে। কত আর সহ্য করা যায়। তাই কোথাও থামলে এক গ্লাস লেবুর শরবত খাই, এটা কিছুটা শান্তি দেয়। এই লেবুর শরবত পরিষ্কার পানিতে বানানো হচ্ছে কিনা যাচাই করেছেন কখনও এই প্রশ্ন করলে তিনি জানান, হ্যাঁ, এগুলো পরিষ্কার পানি দিয়েইতো বানায়। দোকানদারতো তাই বলেছে।

অনেক সময় ধরে খোলা অবস্থায় ফেলে রাখা ধুলোবালিযুক্ত বেল দিয়েই বানানো হচ্ছে শরবত। শরবত বিক্রেতা হাসেমের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এখন ঢাকা শহরে আবার অপরিষ্কার পানি আছে নাকি?  সবই পরিষ্কার পানি। আমি শরবত বানাই ফিল্টারের পানি দিয়ে। ফিল্টার পানি আমাকে দিয়ে যায় যারা পানি (বড় জার) বিক্রি করে।

ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরেছেন দুই কর্মজীবী বন্ধু নাইম ও মিজান। বাংলামোটরে বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশের দোকান থেকে শরবত খাচ্ছিলেন তারা। তারা জানান, তিন ঘণ্টা বাসে ছিলাম। গরমে অস্থির হয়ে গেছি। তাই ঠান্ডা শরবত খেলাম। পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে তারা বলেন, কত কিছুই তো খেয়ে ফেলছি আমরা; এটায় আর কী হবে!

মরজিনা বেগম তার ছোট বোন ও ছোট বোনের মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছিলেন সাভারে। গরমে তৃষ্ণার্ত হয়ে রাস্তার পাশের বিক্রি করা আখের রস খেয়েছেন তারা। তিনি বলেন, এতো গরম সহ্য করা যায় না। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা আখের রস খেলাম। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু আখের ওপর মাছিসহ ধূলোবালি রয়েছে এটাতো ক্ষতিকর, এমনটা বললে তিনি বলেন, আমরা তো আর প্রতিদিন খাই না। এক দুই দিন খেলে কিছু হয় না।

শিহাব নামের আরেক পথচারী তার দুই মেয়েকে নিয়ে আখের রস খাচ্ছিলেন। দুই মেয়ের মধ্যে একজনের বয়স ৫ বছর। এই শিশুকেও দেখা যায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি শরবত খেতে। শিহাব জানান, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গরম লেগেছে বাচ্চাদের, তাই খেলাম। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে এই শরবত তৈরি হচ্ছে। এটা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমনটা তাকে বললে তিনি বলেন, জ্বি আমি এটা জানি।  আর খাবো না।

রাস্তার পাশে ধুলোবালির মধ্যেই খুলে রাখা হচ্ছে বেল, পরে সেগুলো দিয়েই তৈরি হচ্ছে শরবত। যে ক‘জন শরবত বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ হয়, তাদের কাছে পানি ও বরফ কতটা নিরাপদ এই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা নিজেদের পক্ষেই কথা বলেন।

শরবত তৈরির পানি ও বরফ কোথা থেকে আনেন জানতে চাইলে বিক্রেতা শাহীন মিয়া বলেন, আমি ওয়াসার পানি ফিল্টার থেকে কার্ড দিয়ে পানি আনি। আমার পানি পরিষ্কার। বরফ আনি স্টেডিয়াম মার্কেটের একটা দোকান থেকে সেটাও ভালো বরফ।

এই বরফ শরবত বিক্রেতারা শরবতের সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করে। এটা কি খাওয়ার যোগ্য বরফ কিনা জানতে চাইলে বরফ বিক্রেতা মাহমুদ জানান, এটা খাওয়ার বরফ না। এটা এমনি বাইরের কাজে ব্যবহার করার বরফ। খাওয়ার বরফ আলাদা। কেউ অর্ডার করলে আমি খাওয়ার বরফ এনে দেই। আর শরবত বিক্রেতারা যদি এটা খাওয়ার বরফ হিসেবে বিক্রি করে সেটায় তো আমার কিছু করার নেই। আমি বলেই দেই যে এটা খাওয়ার বরফ না।

রাস্তার পাশে বিক্রি করা বাহারি এসব পানীয়র মান ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরীর গণমাধ্যমকে বলেন, প্রচণ্ড গরমে মানুষের শরীর থেকে ঘাম আকারে পানি বের হয়ে যায়, ফলে তীব্র পিপাসা পায়। এসময় পথচারী বা রাস্তায় যারা কাজ করেন তারা রাস্তার পাশে বিভিন্ন ধরনের শরবত বা লেবুর শরবত বা পানীয় পান করে থাকেন। এই পানীয় গ্রহণ করার প্রথম বিপদ হচ্ছে এই শরবতগুলো যে পানি দ্বারা তৈরি করে সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে অনিরাপদ পানি। অর্থাৎ ওয়াসার সরবারহ করা পানি সরাসরি গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত গরমের সময় এই শরবতগুলোকে ঠান্ডা করার জন্য যে বরফ দেওয়া হয় সেগুলোর সবগুলোতেই প্রায় অনিরাপদ পানি ব্যবহার করা হয়। কারণ বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে বরফ বানানোর যে কলগুলো রয়েছে সেখানে কিন্তু নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে আমরা এখনও দেখিনি।

বিক্রেতারা ফিল্টার পানি ব্যবহার করে বলছে, সেগুলো কতটা নিরাপদ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা মিডিয়াতে প্রায় সময়ই দেখি এসব পানির ব্যবসায়ীরা সরাসরি ওয়াসার ট্যাপের পানি জারে ঢুকিয়ে ফিল্টার পানি বলে ব্যবহার করছে। তাই এগুলোর মানও প্রকৃতপক্ষে ভালো না।

পথের পাশের বিক্রি করা পানীয় স্বাস্থ্যঝুঁকি  নিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জানান, এই অনিরাপদ পানি বা বরফ দিয়ে বানানো শরবতগুলো খাওয়ার ফলে পানি বাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড,জন্ডিস, হেপাটাইটিসের মতো রোগগুলো ছড়াতে থাকে। এছাড়া ফুড পয়জনিং, বমিও হতে পারে। গরমের সময় ঢাকায় কিন্তু এই অসুখগুলো বেড়ে যায়। এবারও আমরা এটাই দেখছি। এই বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে যত্রতত্র পথের ধারের এসব শরবত বা পানীয় পান করা।

পানি বাহিত রোগমুক্ত থাকতে এবং সুস্থ থাকার পরামর্শ দিয়ে লেনিন চৌধুরী জানান, যারা বাইরে কাজে বের হবেন তারা যেন বাসার ফুটানো পানি বা ফিল্টারের পানি সঙ্গে নিয়ে বের হন। আর যারা রিকশা চালান বা কায়িক শ্রমের কাজ করেন তারা নিরাপদ পানিতে ওরস্যালাইন দিয়ে যেন পান করেন। এতে শরীর থেকে যে লবণ বের হয়ে হয়ে যায় তার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে এবং অসুস্থতা থেকে আমাদের রক্ষা করবে। এছাড়াও বয়স্ক ব্যক্তি, শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের তিনি এই তাপদাহে বাসার বাইরে না বের হওয়ার পরামর্শ দেন। একইসঙ্গে যারা বাইরে কাজ করেন তাদের ছাতা ব্যবহারের কথাও বলেন তিনি।

 

এবি

×