ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যবহার হচ্ছে নিম্নমানের উপকরণ

যশোরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২১ মার্চ ২০১৮

যশোরে আশ্রয়ণ প্রকল্পে অনিয়ম

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’ এ শ্লোগান নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘সবার জন্য বাসস্থান’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ে কাজ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পরিচালিত এ প্রকল্পের আওতায় বাঘারপাড়ার ৬টি ইউনিয়নে ১শ’ ৩২টি ঘর নির্মাণ হচ্ছে। নির্মাণ কাজে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কমিটির কাউকে কিছু না জানিয়ে, এমনকি কোন সভা না করেই নির্বাহী অফিসার নিজেই কাজ করাচ্ছেন। ঘরের কাজে ব্যবহার হচ্ছে নিম্নমানের মালামাল। উপকারভোগী পরিবার জানিয়েছে, তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে বিভিন্ন উপকরণ। এ কাজে পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকলেও কোন আলোচনা বা সভা ছাড়াই উপজেলা নির্বাহী অফিসার নিজেই সবকিছু করাচ্ছেন। এমন অভিযোগ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। জানা গেছে, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় বাঘারপাড়ার ৬টি ইউনিয়নে ১শ’ ৩২ পরিবারকে এ ঘর দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে জহুরপুর ইউনিয়নে ২১, বন্দবিলায় ২৫, রায়পুরে ৩২, নারিকেলবাড়িয়ায় ২৫, ধলগ্রামে ২৮ ও দোহাকুলা ইউনিয়নে একটি পরিবার রয়েছে। ইতিমধ্যে ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকটি ঘরে উপকারভোগী পরিবার বসবাসও শুরু করেছেন। প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয়ের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ১ লক্ষ টাকা। উপজেলায় মোট বরাদ্দের পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৩২ লক্ষ টাকা। কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ ভাগ টাকাও ব্যয় করা হচ্ছে না। নির্মাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে নি¤œমানের। ২শ’ ৭৫ বর্গফুটের এ ঘরে ০.৩৬ এমএম টিন দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হচ্ছে ০.৩২ এমএম। সেটাও আবার নি¤œমানের। ফলে প্রতি বান্ডিল টিনে ব্যয় কমানো হয়েছে এক হাজার থেকে ১২শ’ টাকা। প্রতিটি ঘরে ৮শ’ পিস করে ইট দেয়া হচ্ছে। এ ইটের মান নিয়ে কোন উপকারভোগী সন্তষ্ট হতে পারেননি। এক নম্বর ইটের বদলে দেয়া হয়েছে তিন নম্বর ইট। যার পার্থক্য মূল্য ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। ঘরের নকশায় ফাউন্ডেশনে ঢালাই দেয়ার কথা থাকলেও কোন ঘরেই তা দেয়া হয়নি। মেঝে ও পিলারে ব্যবহার হয়েছে একেবারেই নি¤œমানের খোয়া ও চিপস। এ কাজে ১শ’ বর্গফুট খোয়ায় টাকা বাঁচানো হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার। মেঝেতে ঢালাইয়ের নিচে পলিথিন দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। যা নেয়া হয়েছে উপকারভোগীর কাছ থেকে। পিলারের অগ্রভাগে সিআইজি শিটের প্লেট, নাট-বোল্ট ব্যবহারের কথা থাকলে ও তা ব্যবহার করা হয়নি। ১৭ পিলার স্থলে দেয়া হয়েছে ১৬টি। এ কাজেও রয়েছে ফাঁকি। ৪টি করে রডের বদলে দিয়েছে ৩টি। দরজায় রং করার নিয়ম থাকলেও তা হয়নি। ঘরের বেড়া ও চালে কাঠ ব্যবহারের তালিকায় রয়েছে শাল, গর্জন, জারুল, কড়ই, শিশু, তাল, পিতরাজ, দেবদারু, আকাশমনি। শুধু দেবদারু কাঠের বার্তা দেয়া হচ্ছে। ঘরের আড়া, রুয়ো ইত্যাদি সব দেয়া হচ্ছে অল্পবয়সি গাছের মেহগনি কাঠ। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মোঃ নুরুন্নবী স্বাক্ষরিত ‘যার জমি আছে ঘর নেই’ তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ কাজের গঠিত কমিটি সংক্রান্ত একটি চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে নির্মাণ কাজের সঙ্গে অবশ্যই শ্রমিক হিসেবে উপকারভোগী পরিবারকে সম্পৃক্ত করতে হবে। অথচ এ আদেশ কোনভাবেই মানা হয়নি। শ্রমিক হিসেবে কাজের সুযোগতো দূরে থাক, উল্টো তাদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উপকরণ। উপকারভোগীর কাছ থেকে শুধু পলিথিনই নেয়া হয়নি। তারকাটা, পেরেক, তার, কব্জা, ছিটকানি, স্ক্রুর ওয়াশার, মেঝের রং এ সবকিছুই নেয়া হয়েছে উপকারভোগীর কাছ থেকে। এ ছাড়াও ইট, বালি, সিমেন্ট, টিন, কাঠ সবকিছুরই পরিবহন ভাড়া দিতে হয়েছে। এরপর সকল মিস্ত্রীর ৮ থেকে ১০ দিন ২ বেলা খাওয়াতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উপকারভোগীর তালিকায় ৫৬ ক্রমিকের রায়পুর ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের বিধবা ছবিরন নেছা (উজালী) বলেন, মিস্ত্রিদের খাওয়া বাদে তার মোট ৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। রায়পুর ইউনিয়নের সদুল্যাপুর গ্রামের অন্ধ ভিক্ষুক বাবর আলী। তার স্ত্রীর নাম চিয়ারুন। তিনি একটি ঘর পেয়েছেন। ঘরের কাজ শেষ হয়েছে। এ সময় বাবর আলী বলেন, ‘আমি এক বস্তা সিমেন্ট, ১৬ কড়াই বালি, মিস্ত্রী খরচ ১৬শ টাকা, তার, পলিথিন, তারকাটা, পেরেক, সিটকানি, কব্জা দিয়েছি। ৩/৪ জন মিস্ত্রীকে ৭ দিন ২ বেলা খাওয়াতে হয়েছে। সব মিলে আমার ৮/৯ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে’। একই রকম বক্তব্য দেন এ গ্রামের ভিক্ষুক মনোয়ারা খাতুন ও নবিরণ নেছা। একই ইউনিয়নের শালবরাট গ্রামের শিখা রাণী দেবনাথের স্বামী কার্তিক চন্দ্র দেবনাথ বলেন, আমি এনজিও থেকে লোন নিয়েছিলাম আট হাজার টাকা। তার সবটাই ঘরের মালামাল কেনা ও পরিবহনে খরচ হয়েছে। একই গ্রামের বিধবা পুষ্প রাণী দেবনাথের ছেলে বিধান দেবনাথ বলেন, আমি টিউশনি করে ৭/৮ হাজার টাকা জমিয়েছিলাম। যার সম্পূর্ণটাই এ কাজে ব্যয় করতে হয়েছে। শুধু ভিক্ষুক, বিধবা আর হতদরিদ্রদের কাছ থেকে এসব ব্যয় নেয়া হয়নি। তাদের কাছ থেকে মালামাল পরিবহন খরচসহ নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উপকরণ। বন্দবিলা ইউনিয়নের গাইদঘাট গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমানের স্ত্রী সালেহা বেগম, নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়নের খানপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম, ধলগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত আলীর কাছ থেকেও পরিবহন ভাড়াসহ অন্য মালামাল নেয়া হয়েছে। উপকারভোগী সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের এ কাজ দেখাশোনা করছেন বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের অফিস সহকারী আসাদুজ্জামান। প্রকল্পের সব মালামাল তিনি তার নিজ বাড়িতেই রেখেছেন। উপকারভোগী সবাই সেখান থেকে মালামাল নিয়ে যাচ্ছেন। আসাদুজ্জামানকে সহযোগিতা করছে তার ছেলে ও ছেলের শ্বশুর। এ বিষয়ে ধলগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান সুবাস দেবনাথ অভিরামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। ইউএনও আমাকে কিছুই জানাননি। এমনকি এ প্রকল্পের কোন সভায়ও ডাকেননি।’ নারিকেলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তাহের আবুল সরদার বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। চেয়ারম্যান হিসেবে খোঁজখবর নেয়ার দায়িত্ব আছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, উপকারভোগী অনেকেই আমার কাছে এসেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন মালামাল পরিবহনসহ প্রায় ৫/৬ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। আমি তাদেরকে বলেছি, সকল ব্যয় সরকারী অর্থে হবে। আপনারা কোন ব্যয় করবেন না। প্রকল্পের সদস্য সচিব প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আপনি সভাপতির (নির্বাহী অফিসার) সাথে কথা বলেন’। প্রকল্পের আরেক সদস্য উপজেলা প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন,‘ এ বিষয়ে আমার কাছ থেকে কোন পরামর্শ নেয়া হয়নি। এমনকি আমার জানা মতে কোন সভাও হয়নি’। বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহনাজ বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘর পেয়ে সবাই খুশি। আমি নিজে অনেক ঘর দেখেছি। আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি’।
×