ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বার্মিজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সীমিত কাজ, সেনা সরঞ্জাম বিক্রয়ের চলমান নিষেধাজ্ঞাসহ কয়েকটি পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বলবত

মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞার পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞার পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথ খুঁজছে বলে হুঁশিয়ার করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কয়েকটি কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথাও উল্লেখ করেছে দেশটি। সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে আরও বলা হয়, রাখাইনে যা ঘটছে, রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্মম সহিংসতা চালানো হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ওই সহিংসতার পেছনে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট এই বিবৃতিতে আরও বলেন, আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত ঘটনাগুলোর জন্য। সেখানে সহিংস ও মানসিক নির্যাতন যা রোহিঙ্গা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ সহ্য করেছে। যে কোন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী এবং পাহারা দেয়ায় নিযুক্ত সদস্যসহ, নৃশংসতার জন্য কেউ দায়ী হলে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা অপরিহার্য। সে অনুযায়ী, বার্মিজ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের সীমিত পরিসরে কাজ করা এবং দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য সবরকম সেনা সরঞ্জামাদি বিক্রয়ের ক্ষেত্রে চলমান নিষেধাজ্ঞাসহ, জবাবদিহিতা এবং সহিংসতা বন্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, গত ২৫ আগস্ট থেকে বর্তমান ও সাবেক বার্মিজ সামরিক বাহিনীর উর্ধতন নেতৃবৃন্দের জন্য জেড এ্যাক্ট ভ্রমণ শিথিলতার সম্ভাবনা আমরা বন্ধ করেছি। সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট করে তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অবরোধের উপায়গুলো নিয়ে ভাবতে জেড এ্যাক্টের অধীনে সুযোগগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। আমরা মনে করি বার্মার উত্তরে রাখাইন রাজ্যের সামরিক কর্মকা-ে যেসব কর্মকর্তা ও ইউনিট জড়িত তাদের কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপ্রাপ্ত কোন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণের জন্য যোগ্য হবে না। বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তাপ্রাপ্ত কোন অনুষ্ঠানে যেন যোগদান করতে না পারেন সেজন্য আমরা তাদের ইতোমধ্যে প্রদত্ত আমন্ত্রণ বাতিল করেছি। আমরা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে মিলে আহ্বান জানাচ্ছি বার্মা যেন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমকে প্রয়োজনীয় এলাকায় অবাধ প্রবেশাধিকার দেয়। আমরা আমাদের বন্ধু ও সহযোগীদের সঙ্গের জাতিসংঘ, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল ও অন্যান্য যথাযথ অবস্থানে বার্মার জবাবদিহিতার বিষয়ে আলোচনা করছি। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অধীনে আমরা জবাবদিহিতার পদ্ধতি খুঁজে দেখছি, যার মধ্যে রয়েছে গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি বা নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা। হিদার নোয়ার্ট আরও বলেন, আমরা বার্মার গণতন্ত্রের উত্তরণে সমর্থন অব্যাহতও রাখব, পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যে বর্তমান সঙ্কট সমাধানে কাজ করে যাব। বার্মা সরকার ও তাদের সামরিক বাহিনীকে, অবশ্যই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে; যে গোষ্ঠীগুলো খুবই প্রয়োজনে আছে তাদের মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন। যারা রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে অথবা বাস্তুহারা হয়েছে তাদের নিরাপদ ও স্বেছায় ফিরে যেতে সহযোগিতা করা ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই পদ্ধতিগত বৈষম্যের মূল কারণ এবং রাখাইন এ্যাডভাইজরি কমিশনের প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করা যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ খুঁজে বের করা। আমরা এই প্রচেষ্টার সমর্থন দিতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী নতুন করে অভিযান শুরুর পর গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তারা বলছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সেনা সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছে, নারীরা হচ্ছেন ধর্ষণের শিকার। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, অভিযান শুরুর পর এক মাসেই ২৮৮টি রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার প্রমাণ পেয়েছে তারা। মিয়ানমারের নেত্রী সুচি সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই হিসেবে বর্ণনা করলেও জাতিসংঘ একে চিহ্নিত করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি দেখতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। এমনকি সেখানে আইসিআরসি ছাড়া অন্য কোন সংস্থাকে ত্রাণ দিতেও বাধা দেয়া হচ্ছে। এর মাসুল গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোকে। বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য খাবার, পানি, আশ্রয় আর ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত ৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে শুনানিতে কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য ও কর্মকর্তা রোহিঙ্গা নিপীড়ন থামাতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা সাহায্য বন্ধের মতো পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারের ওপর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল। ২০১৫ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরার সময় যুক্তরাষ্ট্র সেসব কড়াকড়ি তুলে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন গত সপ্তাহে বলেন, রাখাইনে যেসব সহিংসতার খবর আসছে, বিশ্ব তা দেখেও চুপ করে থাকতে পারে না। যা ঘটছে সেজন্য আমরা মিয়ানমারের সামরিক নেতৃত্বকেই দায়ী করব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নিতে আগামী মাসের শুরুতে প্রথমবারের মতো এশিয়ার ওই অঞ্চলে যাচ্ছেন। ম্যানিলায় ওই সম্মেলনে মিয়ানমারও অংশ নিচ্ছে। ট্রাম্পের ওই সফরের আগেই এ যাবৎকালের সবচেয়ে কঠোর ভাষায় মিয়ানমারকে হুঁশিয়ার করল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর।
×